‘মুড়ির টিন’ আমাদের যাপিত জীবনের গল্প
‘হালুগাডত্তুন ছাইজ্জি গারি লই আল্লার নাম
একগন্টা ফার ঐগেইয়্যে আইযু বদ্দারাট ন’ আইলাম…।’
(লাইন দুটির মানে হলো, কালুরঘাট থেকে ছেড়েছে গাড়ি আল্লাহর নাম নিয়ে, এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল এখনো বহদ্দারহাট আসলাম না।)
আঞ্চলিক ভাষার কারণে কথাগুলো বোঝা যাক বা না-যাক, এখন লাখ লাখ সংগীতপ্রেমী তাল মেলাচ্ছেন গানটির তালে। এরই মধ্যে অনেকের প্লে-লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে ‘মুড়ির টিন’ শিরোনামের গানটি। এটি কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় সিজনের প্রথম গান। কোমল পানীয় কোকা-কোলার আন্তর্জাতিক সংগীতায়োজনের বাংলাদেশি সংস্করণের গানটিতে স্থান পেয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক ভাষার গান হলেও কোক স্টুডিও বাংলার অন্যান্য গানের মতো এ গানটিও এখন সবার মুখে মুখে।
গানটির মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকদের নজর কেড়েছেন সংগীতশিল্পী রিয়াদ হাসান। তিনি এ গানের গীতিকার ও সুরকারও। নিজের গান ও কোক স্টুডিও বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাই তরুণ এই সংগীতশিল্পীর কাছে। রিয়াদ হাসান বলেন, ‘গান গাওয়া আর লেখার চেষ্টা করছি অনেক দিন ধরে। প্রমিত বাংলায় গান লিখছি। আমার বাড়ি চট্টগ্রামে। কালুরঘাটে আমার বেড়ে ওঠা। তাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি অন্য রকম একটা টান তো আছেই। সেই টানেই নিজ এলাকার ভাষায় গান লেখা-সুর করা এবং গাওয়া। মুড়ির টিন আমাদের যাপিত জীবনের গল্প।’
গানের চর্চার শুরু এবং অনুপ্রেরণার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রিয়াদ হাসান বলেন, ‘আমার গান লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রামের দুজন লোকসংগীতশিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ। তাঁদের গানে সব সময় যাপিত জীবন ও আঞ্চলিক নানা বিষয় ছিল। এমনভাবে তারা গান বানাতেন আর গাইতেন যে দর্শক-শ্রোতা হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করত। তাঁদের মতো করে বর্তমান সময়টাকে ধরে গান লিখতে চেষ্টা করি।
এমন সব বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি, যার সঙ্গে মানুষ নিজেকে যুক্ত করতে পারবে। ২০০৮-০৯ সালে ‘‘জিইসি মোড়’’ শিরোনামে একটা গান বানিয়েছিলাম। আমার প্রথম অ্যালবাম মুক্তি পায় ২০১৪ সালে। সেখানে একটা গান ছিল ‘‘ডিজিটাল ফোয়া’’ মানে ডিজিটাল ছেলে। পরবর্তী সময় আরেকটা গান করি ‘‘সাতকানিয়া ফটিকছড়ি’’ শিরোনামে। আঞ্চলিক গান নিয়েই কাজ করছিলাম। সেই সূত্র ধরে ডাক পাই কোক স্টুডিও বাংলায়। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন গানটির সংগীত পরিচালক শুভেন্দু দাস শুভ।’
গানটি লেখার নেপথ্য গল্প জানতে চেয়েছিলাম রিয়াদ হাসানের কাছে। তিনি জানান, কালুরঘাটের মতো একটি উপশহরে তিনি নিজে ছিলেন এবং সেখানকার বাসযাত্রা দেখেছেন। সাধারণত লোকাল বাসগুলো যেমন হয়, যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে যাওয়া, গাদাগাদি, যাত্রীর চেঁচামেচি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যখন ভাবলেন, তখন মনে হলো, এটা নিয়ে গান লেখা যায়। রিয়াদ বলেন, ‘এই গান যতটা না গান, তার চেয়ে বড় বিষয়, এটা আমার জন্য একটা আনন্দের জার্নি।
সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণবের সঙ্গে কাজ করা, কাজ শেখা, অভিজ্ঞতা অর্জন অনেক বড় পাওয়া আমার জন্য। গান লেখার পর অর্ণব দা মতামত দেন আরও দুটো আঞ্চলিক ভাষা এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়। এমন ভাবনা থেকেই সিলেট ও খুলনার ভাষা যুক্ত হয় র্যাপ আকারে। গানটি প্রাথমিকভাবে সুরারোপের ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার বাইরে করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমেরিকান কান্ট্রি মিউজিকের ধাঁচে মিউজিক দেওয়া হয়েছে। সংগীত পরিচালনা করেছেন শুভেন্দু দাস শুভ। গানটির খুলনার ভাষার গায়ক ছিলেন তৌফিক আহমেদ। আর সিলেটের ভাষায় গেয়েছেন পল্লব।’
‘কেউ উঠে, কেউ নামে, কেউ থামে… ’ এ লাইনগুলো দিয়ে সিলেটি ভাষায় আমি মানুষের জীবনের উত্থান-পতন এবং মৃত্যুর কথাই বুঝিয়েছি। ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে সুরমা নদীতে পড়ে যাওয়া মানে জীবনের অধঃপতন—পুরো বাসজার্নিটাকে আমি জীবনের জার্নির সঙ্গে তুলনা করেই গেয়েছি,’ বললেন র্যাপার পল্লব।
‘মুড়ির টিন’ গানের আরেক র্যাপার তৌফিক আহমেদ বলেন, ‘খুলনায় ড্রাইভারকে ‘‘পাইলট’’বলে। এই পাইলট ধীরে চালালেও সমস্যা, দ্রুত চালালেও সমস্যা। তো উনি করবেনটা কী? চালকের হয়ে চালকের দুঃখের কথা গানে গানে বলে দিয়েছেন তৌফিকই, নিজ এলাকার ভাষায়।’
‘আপনারা তো এখন সেলিব্রিটি। সবার মুখে মুখে আপনাদেরই নাম, প্রশংসা…।’ বাক্যটি শেষ না হতেই হেসে ওঠেন রিয়াদ হাসান। বলেন, ‘এই গান আমাকে মানুষের ভালোবাসা এনে দিয়েছে আরও বেশি করে। কোক স্টুডিও বাংলা আমার কাছে স্বপ্নের মতো। এত বড় একটা প্ল্যাটফর্মে নিজের লেখা-সুরে গান করলাম, মানুষজন দেখছেন, শুনছেন, লাখ লাখ ভিউ হচ্ছে। সবাই খুব প্রাণোচ্ছলভাবে গানটাকে ধারণ করছে—এটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য খুব আনন্দ ও অনুপ্রেরণার বিষয়।’