কোথায় আছেন, কেমন আছেন ‘রং নাম্বার টেলিফোনে’ গানের সেই গায়ক

আদনান বাবু কখনো পেশা হিসেবেও নেননি সংগীতকে। ছবি: সংগৃহীত

নব্বই দশকের শুরুর দিক। অ্যানালগ টেলিফোনের যুগ। হঠাৎ করেই রং নম্বরে পরিচয় হয়ে যেত অপরিচিত দুজন মানুষের। পরিচয় থেকে প্রণয়, প্রণয় থেকে হয়তো পরিণয়। তখন রং নম্বরে প্রেম সাদামাটা ঘটনা হলেও কেউ এটাকে গানের ভেতর নিয়ে আসার কথা ভাবেননি। সম্পূর্ণ নবীন এক শিল্পী আদনান বাবু যখন টেলিফোনে প্রেমের থিম নিয়ে ‘রং নাম্বার’ গানটি গাইলেন, তখন সেটাকে সারা দেশের শ্রোতাদের বড় অংশ লুফে নিল।

১৯৯১ সালে গান প্রকাশের পর কেটে গেছে প্রায় ৩০ বছর। এখনো আদনান বাবু কোথাও গেলে, ‘রং নাম্বার’-এর শিল্পী বলে পরিচয় দিলে তাঁর সমাদর বেড়ে যায়। শিল্পী নিজেই জানালেন, অনেকে গানটি মনে রাখলেও ভুলে যান আদনান বাবুর নাম। উল্টোটাও নাকি ঘটে। আদনান বাবু নাম শুনলে চিনতে পারেন। কোন গান গেয়েছেন মনে করতে পারেন না। ‘রং নাম্বার’-এর কথা বলতেই চিনে ফেলেন। এমনও বলেন অনেকে, “ভাই “রং নাম্বার” শুনলে আপনার কথা মনে পড়ে।’ আদনান বাবু মনে করেন, এটা তাঁর ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়।

তাঁর মতে, সংগীত বিপুল সাধনার ব্যাপার। তিনি কখনোই সেই সাধনা করতে পারেননি। ‘রং নাম্বার’ রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে তাঁকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তিনি কখনোই চাননি জনপ্রিয় শিল্পী হতে। কখনো পেশা হিসেবেও নেননি সংগীতকে।

বেশ কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস ব্যবসা করছেন। পাশাপাশি চালাচ্ছেন একটি এনজিও। এমনকি যখন তিনি ‘রং নাম্বার’ অ্যালবাম প্রকাশ করেন, তখনো তিনি চাকরি করেন একটি বায়িং হাউসে। ‘৮৯ থেকে ’৯৫ সাল পর্যন্ত সেই চাকরি করেছেন আদনান বাবু।

চাকরির মাঝখানেই ‘রং নাম্বার’ প্রকাশ করেন তিনি। এরপর আরও ৮-১০টি একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন। তাঁর অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রং নাম্বার টু’, ‘আনন্দ’, ‘রং বেরং’, ‘চেয়েছি প্রেম’, ‘নিঃশ্বাসে আছ তুমি’ প্রভৃতি। ১০-১২টি মিশ্র অ্যালবামেও গান গেয়েছেন। তাঁর শেষ অ্যালবাম ‘হৃদয়ে আছো তুমি’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে, যার কাজ শুরু করেন ২০০৭ সালে। সংগীতার ব্যানার থেকে অ্যালবামটি বাজারে আসে। ২০১৯ সালে একুশে টিভিতে একটি গানের অনুষ্ঠানে শেষ পারফর্ম করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ধরে বিটিভিতে ‘গীতি আলাপন’ নামে একটি গানের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করেছেন। অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে আর বিটিভিতে কাজ করা হয়নি।

শিল্পী নিজেই জানালেন, অনেকে গানটি মনে রাখলেও ভুলে যান আদনান বাবুর নাম। উল্টোটাও নাকি ঘটে। আদনান বাবু নাম শুনলে চিনতে পারেন। কোন গান গেয়েছেন মনে করতে পারেন না। ‘রং নাম্বার’-এর কথা বলতেই চিনে ফেলেন।
আদনান বাবু
ফেসবুক থেকে

আদনান বাবু বিটিভির বিশেষ তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী ও সংগীত পরিচালক। তালিকাভুক্ত শিল্পী না হয়েও গান গেয়েছেন বেতারে। দু-একটি সিনেমায়ও প্লেব্যাক করেছেন। তিনি জানান, করোনার আগে দুটি একক গান তৈরি করে রেখেছেন। গান দুটি ছাড়ার ইচ্ছে আছে অচিরেই। এভাবেই টুকটাক গানের সঙ্গে যোগসূত্র আছে। পুরো সময় দেন ব্যবসায়। স্ত্রী আফসানা ফেরদৌসী আর একমাত্র ছেলে আহনাফ শারার রাইনকে নিয়ে তাঁর সংসার। থাকেন ঢাকার মহাখালীতে নিজের বাড়িতে। নিজের অফিসও বাসার কাছেই মহাখালী ডিওএইচএসে।

এখনকার গানবাজনা নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাইলেন না আদনান বাবু। ‘সংগীত নিয়ে মন্তব্য করার মতো শিক্ষা আমার নেই। শুধু বলব, সংগীত স্রষ্টাপ্রদত্ত। চাইলেই কেউ গান করতে পারে না। চাইলেই কেউ সৃষ্টি করতে পারে না। এখন যন্ত্রপাতি থাকলে যে কেউ গাইতে পারে, গায়ক সাজতে পারে। আপনার যদি টাকা থাকে, পরিচয় থাকে, যন্ত্রপাতির মালিকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে, আপনি গান গাইতে পারবেন। আমরা মেধা দিয়ে, মন দিয়ে গানটা করতাম। গান তৈরি করার পর প্রথমেই চিন্তা করতাম, নিজেদের কাছে কেমন লাগছে। আমাদের ভালো লাগা আগে। এরপর আসত শ্রোতাদের চিন্তা। নিজেদের জন্য গাইতাম প্রথমে। পরে ভাবতাম শ্রোতাদের কথা। আর এখন প্রথমে ভাবা হয় শ্রোতাদের কেমন লাগবে। কীভাবে গান করলে শ্রোতারা নেবে। নিজেদের ভালো লাগুক না লাগুক, শ্রোতাদের ওপর গান চাপিয়ে দেওয়া হয়। চাপানো জিনিস কখনোই শ্রোতাদের ভালো লাগতে পারে না।’

আদনান বাবু বিটিভির বিশেষ তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী ও সংগীত পরিচালক। ছবি: সংগৃহীত

আদনান বাবু আরও মনে করেন, ‘ভালো গাইলেও হবে না। ভাগ্যের সহায়তাও লাগবে। আমরা শুধু নিজেদের সেরাটা দিতে পারব। বাকিটা ওপরওয়ালার ইচ্ছা।’

আদনান বাবু জানান, তাঁর শেষ অ্যালবামের জন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দিয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা। তিনি একদিন শুনলেন, প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী দুটি গান তৈরি করেছেন নিজের টাকায়। কোথায় দেবেন তা-ই এখন ভাবছেন। ‘নিজের টাকায় গান করে শ্রোতাদের শোনাতে হবে, এমনভাবে আমি গান করতে পারব না। গান করে সেগুলো বুস্ট করতে হবে, স্ক্যান্ডাল করে বাজারে গান চালাতে হবে, এসব কথা আমি শুনতেও রাজি নই।’ কিছুটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন আদনান বাবু।

আদনান বাবু এ-ও বারবার বলছিলেন, তিনি নিজেকে বড় কণ্ঠশিল্পী মনে করেন না। গানের জগতে তাঁর অর্জন একেবারেই কাকতালীয়। ‘পুরস্কার’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করার সময় এ ছবির প্রযোজক ও সুরকার সত্য সাহা তাঁর মাথায় গানের পোকা ঢুকিয়ে দেন। তাঁর উৎসাহে গান গাইতে শুরু করেন। একসময় ‘রং নাম্বার’ অ্যালবাম করে ফেলেন। সেই অ্যালবামের গানের জন্য এত বছর পরও শ্রোতারা তাঁকে মনে রেখেছেন। এ জন্য তিনি শ্রোতাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যদিও নিজেকে শিল্পী ভাবতে তাঁর ভালো লাগে না। তিনি গান করেছেন শখের বশে।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)