আগে তো সোবহানবাগে থাকতেন। উত্তরা গেলেন কবে?
তানযীর তুহীন : মাত্রই এলাম! প্রায় ৫০ বছর ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম। পাঁচ মাস আগে এখানে এসেছি। তাই বলাই যায় মাত্র। আমার বেড়ে ওঠা থেকে পড়াশোনা, আড্ডা, আর্কিটেকচার ফার্ম, সংগীত—সব ওই এলাকায়। উত্তরায় ১৭ বছর আগে মা জায়গাটা নিয়েছিলেন, তাঁর ইচ্ছাতেই বাড়িটি করা। তাঁর সঞ্চয়ের সঙ্গে বড় ভাই আর আমি মিলে এটা শেষ করলাম। মৃত্যুর আগে উনি কিছুদিন এখানে থাকতে পেরেছেন, এটা একটা আত্মতৃপ্তি। এলাকাটা খারাপ লাগছে না।
প্রথম আলো :
মাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন...
তানযীর তুহীন : তিন মাস হচ্ছে মা চলে গেলেন। এখনো সামলে উঠতে পারিনি। ছোটবেলায় খাইয়ে দেওয়া থেকে গান শেখানো, পেনসিল ধরা—সব তো তাঁর হাতে হয়েছে। এখনো তাঁর স্পর্শটা মিস করি। এই বাসার দোতলায় মা থাকতেন। তাঁর রুমে যাই, বিছানায় ঘুমাই, মা যেন আমার সঙ্গেই আছেন। এদিন তিনি না থাকার শূন্যতা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর জন্মদিন ওইভাবে ঘটা করে উদ্যাপন করা হয় না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সময় কেটে যায়।
নজরুল, রবীন্দ্র ও শাস্ত্রীয় সংগীত শেখার পর রক ঘরানায় এলেন কী করে?
তানযীর তুহীন : চার বছর বয়স থেকে গান শিখি। প্রথম শিক্ষক মা। এরপর নজরুল পরিষদ, বাফাতে (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি) নজরুলসংগীত শিখলাম। এরপর রবীন্দ্রসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছি। ‘নতুন কুঁড়ি’সহ আরও কিছু প্রতিযোগিতাতেও অনেক কিছু শিখেছি। শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আখতার সাদমানি, কিরণচন্দ্র রায়, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী এবং ওস্তাদ নারায়ণচন্দ্র বসাকের মতো গুণী মানুষেরা আমাকে তালিম দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর রক ঘরানার গানের প্রতি টান অনুভব করলাম। বন্ধুরা মিলে ‘শিরোনামহীন’ শুরু করলাম। তবে মঞ্চে না করলেও পারিবারিক আড্ডায়, ঘরোয়া আয়োজনে নজরুলসংগীত করা হয়। মা প্রায়ই শুনতে চাইতেন, মাকে শোনাতাম।
প্রথম আলো :
বন্ধুদের নিয়ে শিরোনামহীন শুরু করেছিলেন, একসময় ছেড়ে এলেন। বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?
তানযীর তুহীন : দেখুন, পরিবারে কত কিছুই তো হয়। আমাদের মধ্যেও তেমন কিছুই হয়েছিল। বন্ধুত্ব তো আর এক–দুই দিনের নয় যে ভেঙে যাবে। তারা শিরোনামহীন করছে, আমি আভাস করছি, ভালোবাসা পাচ্ছি। আমি মনে করি, শিরোনামহীনের যে লিগ্যাসি, এটি ব্যক্তির চেয়ে বড়। আর ব্যান্ড সংগীতে ভাঙাগড়া স্বাভাবিক ঘটনা। এভাবে ভেবে দেখলেই ঝামেলা থাকে না। আমার বন্ধুরা ভালো থাকুক।
প্রথম আলো :
শুনলাম আভাসের নতুন গান আসছে...
তানযীর তুহীন : আভাসের ষষ্ঠ গান ‘সত্তা’। ২৭ তারিখে রিলিজ পাবে। আসলে আমরা সবাই একটা সত্তা নিয়ে বেড়ে উঠি। এ গানের মাধ্যমে আমরা বলতে চেয়েছি, সবাই যেন সবার সত্তাকে চিনতে পারে। নিজেকে যেন নিজে ভালো রাখে। তাহলেই সে অন্যকে ভালো রাখতে পারবে।
সংগীতজীবনে অনেকের সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। কাদের বেশি মিস করেন?
তানযীর তুহীন : আজম (খান), (আইয়ুব) বাচ্চু ভাইকে ভীষণ মনে পড়ে। শাফিন (আহমেদ) ভাইকে মিস করি। অনেকেই আছেন। তবে গীতিকার রাজীব আশরাফের কথা বেশি মনে পড়ে। এত ভালো লিখত ও, ওর মতো গীতিকবি আমরা পাব না আর, এর জন্য অনেক কষ্ট হয়।
প্রথম আলো :
অনেকেই বলেন, সংগীতশিল্পীদের মধ্যে আগের মতো হৃদ্যতা নেই, এখন সবাই সবার প্রতিযোগী।
তানযীর তুহীন : প্রতিযোগী কি আগে ছিলাম না একজন আরেকজনের? হ্যাঁ, এখন আগের মতো আড্ডা হয় না। এর মূল কারণ ঢাকায় আগে নির্দিষ্ট কিছু প্র্যাকটিস প্যাড আর রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল। একজনের পর একজন এখানে আসতেন। এখন আর সেদিন নেই। আর ঢাকার ট্র্যাফিক জ্যামও একটা কারণ। তবে কনসার্টে সবার সঙ্গে দেখা হয়। জেমস ভাইসহ সিনিয়রদের সঙ্গে দেখা হলে সেই পুরোনো আড্ডা জমে যায়।
প্রথম আলো :
৫৫ বছর বয়সে অবসর নেবেন বলেছিলেন। মজা করে বলা, নাকি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত?
তানযীর তুহীন : অবসর নয় ঠিক। কাজ কমিয়ে দেব। হয়তো বছরে একটা–দুইটা কনসার্ট আর কিছু কাজ করব। তবে এখনকার মতো সারা বছর নয়। গান তো আর ছাড়া যায় না, সংগীতজীবনের আবার অবসর কী!
অনেক সংগীতশিল্পীই দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন, আপনার পরিকল্পনা কী?
তানযীর তুহীন : এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় আমি আজকের তানযীর তুহীন। এ দেশ ছেড়ে কোথায় যাব? এখানকার একজন রিকশাওয়ালা থেকে শ্রমিক আমাকে চেনে, আমাকে ভালোবাসে, এটা আমি কোথায় পাব? দেশ ছাড়ার মতো যখন বয়স ছিল, তখনই ছাড়িনি, আর এখন দেশের অবস্থা এমন কোনো পর্যায়ে আসেনি যে দেশ ছাড়তে হবে। এমন অবস্থা কখনো হবে, আমি বিশ্বাস করতে চাইও না। বাইরে ঘুরতে যাই, যাব, কিন্তু এ মাটি ছেড়ে কোথাও থাকতে চাই না।
প্রথম আলো :
অডিও ইন্ডাস্ট্রির রমরমা দেখেছেন, অ্যালবাম থেকে এখন সিঙ্গেল ট্র্যাক, এ পরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
তানযীর তুহীন : এখন চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়েছে। আগে অ্যালবামে সব শ্রেণির শ্রোতাদের জন্যই ট্র্যাক থাকত। সবাই সবারটা পছন্দ করে নিত। কিন্তু এখন একটা করে গান মুক্তি পাওয়ার ফলে সবাইকে সন্তুষ্ট করা ভীষণ চ্যালেঞ্জের।
প্রথম আলো :
ছোট পর্দায় অভিনয়ও করেছিলেন। এখনো সেসব নাটকের ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হতে দেখা যায়। নিয়মিত অভিনয় করলেন না কেন?
তানযীর তুহীন : মেজবাউর রহমান সুমন, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল আমার ভাই বন্ধু। তাঁদের অনুরোধে অভিনয় করা। এরপর অনেক প্রস্তাব পেয়েছি। তবে আমি তো অভিনেতা নই, তাই এসব প্রস্তাব সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়েছি। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। এখন যখন সেসব ক্লিপ দেখি, অনেক নস্টালজিক লাগে।
অনেকে বলেন, বর্তমানে তরুণদের নিয়ে তো প্রবীণেরা আশাহত, আপনি কতটা আশাবাদী?
তানযীর তুহীন : যদি এমনটাই বলে, তবে আমি বলব, এই দায় কার? অবশ্যই প্রবীণদের। আজকের শিক্ষাব্যবস্থা কোন জায়গায় এসেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক, পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এখানে তরুণদের দোষ দিয়ে কি পার পাওয়া যাবে? ৯০ শতাংশ পাস, ভূরি ভূরি জিপিএ ফাইভ, কিন্তু ভেতরে ফাঁকা, ভবিষ্যৎকে তো আমরাই অন্ধকারে ফেলে দিয়েছি। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এসব জিনিস ঢেলে না সাজালে আগামী পঞ্চাশ বছরেও আমরা দাঁড়াতে পারব না।
প্রথম আলো :
অস্ট্রেলিয়া ট্যুর শেষ করে এলেন, অভিজ্ঞতা কেমন?
তানযীর তুহীন : কুমার বিশ্বজিৎ দাদার সঙ্গে দুটি শোতে অংশ নিলাম। অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আরও কয়েকটি শোর প্রস্তাব ছিল, কিন্তু দেশে ফেরার তাড়া থাকায় সেগুলো করতে পারিনি।
প্রথম আলো :
দেশ–বিদেশের অনেক মঞ্চেই তো পারফর্ম করেছেন, সবচেয়ে পছন্দের মঞ্চ কোনটি?
তানযীর তুহীন : অবশ্যই আমার বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়া, এরপর জাহাঙ্গীরনগরের মুক্ত মঞ্চ। একজন শিল্পীর কাছে প্রতিটা মঞ্চই তো প্রিয়, তবে আমার কাছে এ দুটো জায়গা স্পেশাল। বুয়েট থেকেই তো বেড়ে উঠেছি, এখনো সেখানে পারফর্ম করলে সেই সময়ে ফিরে যাই। চোখ বন্ধ করলেই বন্ধুদের দেখি, কত আড্ডায় কেটেছে সময়। আর জাহাঙ্গীরনগরে শুরুর সময়ের বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে। তাই এ দুই জায়গা আমার কাছে বিশেষ।