জীবনকে নতুনভাবে চিনেছিলেন জাকির হোসেন
তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেনের মৃত্যুর পর প্রথম জন্মদিন আজ। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরে ৭৩ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম জন্মদিনে আবেগাপ্লুত ভক্তরা।
১৯৫১ সালে ভারতের মুম্বাই শহরে তাঁর জন্ম। বাবা কিংবদন্তি তবলাবাদক আল্লারাখা। তিন বছর বয়স থেকে বাবার কাছে তবলায় তাঁর হাতেখড়ি। ১২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে তাঁর প্রথম কনসার্ট। সেই থেকে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ভারতজুড়ে। বাদ্যশৈলীর মধ্য দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের সংগীতজগৎকে খুব কাছাকাছি আনতে পেরেছিলেন তিনি।
বাবার এই খ্যাতির পরও শৈশব ও কৈশোরে বেশ সংগ্রামের দিন পার করতে হয়েছে জাকির হোসেনকে। সংগীত পরিবারের অর্থকষ্ট দেখে মা চেয়েছিলেন, নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য সংগীতের বাইরে পড়াশোনায় মনোযোগী হবেন জাকির। কিন্তু তাঁকে পড়াশোনা তেমন টানত না। এর জন্য কৈশোরে বাড়ি থেকেও পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন জাকির হোসেন।
আল্লারাখা বিভিন্ন শহরের কনসার্টে জাকির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সন্তানকে সব সময় কাছাকাছি রাখতেন। ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের এ আবহে বড় হওয়ার পরও পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের মোহ জন্মাতে থাকে জাকিরের। ভেবেছিলেন, এ সংগীতসাধনা তাঁকে একসময় খ্যাতি ও অর্থ দেবে।
১৯৯৮ সালে সিমি গারেওয়ালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই স্মৃতি হাতড়ে জাকির হোসেন বলেছিলেন, ‘জিনস আমার বেশ ভালো লাগত। সে সময় আমি একজন রক অ্যান্ড রোল তারকা হতে চেয়েছিলাম। মিলিয়ন ডলার আয় করতে চেয়েছিলাম। কাঁধে বুমবক্স নিয়ে বোম্বের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, ডোরস এবং বিটলস শুনতাম। তখন মনে হয়েছিল, প্রচুর অর্থ উপার্জন ও খুব দ্রুত বিখ্যাত হওয়ার এটিই উপায়।’
একদিন সে ভুল ভাঙে জাকির হোসেনের। ১৯৭০ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পর থেকেই জীবনের বাস্তবতা ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে থাকেন তিনি। প্রাচুর্যের মধ্যে পৌঁছেও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ আবিষ্কার করেন তিনি। জাকির হোসেনের কথায়, ‘তখন সপ্তাহে ২৫ ডলারে জীবন নির্বাহ করতাম। একটি সবজির তরকারি রান্না করতাম, আর প্রতিদিন তা গরম করে রুটির সঙ্গে খেতাম।’
তবে সে সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি জাকির হোসেনের। কয়েক বছরের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সংগীতাঙ্গনে বিচরণ করতে থাকেন তিনি। ১৯৭৩ সালে জর্জ হ্যারিসনের ‘লিভিং ইন দ্য ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড’ অ্যালবামে অংশগ্রহণ তাঁকে এনে দেয় এক বিরাট স্বীকৃতি। এর পর থেকেই বহু খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী, যেমন জন ম্যাকলাফলিন, মিকি হার্ট, বিল ল্যাসওয়েল, ভ্যান মরিসন, জো হেন্ডারসনসহ আরও অনেকের সঙ্গে তবলা পরিবেশন করেন তিনি।
সংগীতে তাঁর কর্মজীবনের বেশির ভাগজুড়ে রয়েছে ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত। তাঁর তবলা দিয়ে সঙ্গ দিয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, শিব কুমার শর্মা বা কত্থক নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজকে। ১৯৯২ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মোমেন্ট রেকর্ড’।
এর মাধ্যমে তিনি সংগীতানুরাগীদের উপহার দিয়েছেন ভারতের ধ্রুপদি সংগীতের খ্যাতিমান সেরা সংগীতশিল্পীসহ সমকালীন বিশ্বসংগীত। ২০০৬ সালে ‘মোমেন্ট রেকর্ড’-এর মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যালবাম ‘গোল্ডেন স্ট্রিং অব দ্য সরোদ’ গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, গ্র্যামি ছাড়া আরও বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জাকির হোসেন।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এনডিটিভি