সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান করে একটি প্ল্যাটফর্ম পেলাম আমি: অনুপ ঘোষাল

চলে গেলেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অনুপ ঘোষাল। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে গান করতে এসেছিলেন বরেণ্য এ কণ্ঠশিল্পী। সে সময় প্রথম আলো বিনোদনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অনুপ ঘোষাল স্মরণে আলতাফ শাহনেওয়াজের নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশ করা হলো।  

অনুপ ঘোষালখালেদ সরকার

‘মোরা দুজনায় রাজার জামাই’ কিংবা ‘পায়ে পড়ি বাঘমামা’—এই গানগুলো ভেতর থেকে গুনগুনিয়ে উঠছে। ঢাকা ক্লাবের লাউঞ্জে আমরা বসে আছি একজনের অপেক্ষায়। টেলিভিশনে চলছে দক্ষিণ আফ্রিকা-নেদারল্যান্ডসের খেলা। আমরা টিভি স্ক্রিনে চোখ রাখি, কিন্তু ভেতর থেকে বারবার উছলে ওঠে, ‘মোরা দুজনায় রাজার জামাই’।  
অতঃপর তিনি এলেন। গায়ে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, ‘কী জানতে চান বলুন? আজ রাতে আমাকে গান করতে হবে। বেশি কথা বলব না। তাহলে গলা গলে যেতে পারে।’—প্রথম পরিচয়ে তাঁর বলা কথাগুলো এর মধ্যেই আমাদের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে। এত কাট কাট কথা! মানুষ এত মেজাজি হয়, আমরা ভাবছি। আর মনে হচ্ছে, এই মানুষই নাকি সত্যজিৎ রায়ের গুপি গাইন বাঘা বাইন কিংবা হীরক রাজার দেশে ছবিতে গান করেছেন, এই লোকের নজরুলসংগীতের ঘোরেই কি আমাদের অজস্র দিনরাত পার হয়েছে!
অনুপ ঘোষালের কথা বলছি। কয়েক দিন আগে নজরুলসংগীতের এই বিখ্যাত শিল্পী দেশ টিভিতে গান পরিবেশনের জন্য এসেছিলেন বাংলাদেশে। সেই মওকায় তাঁর মুখোমুখি আমরা।
আপনার গানে হাতেখড়ি কীভাবে? উইকিপিডিয়া বলছে, মা লাবণ্য ঘোষালের কাছে আপনার প্রথম গান শেখা।

সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন অনুপ ঘোষাল, ‘শুধু মা নয়, আমার দিদি গীতা সেনগুপ্তর কাছেও আমি গান শিখেছি। আসলে খুব ছোট বয়স থেকে আমি গানের ভেতরেই বড় হয়েছি। এরপর “শিশুমহল” নামে এক অনুষ্ঠানে গান করতাম। আমি তখন অনেক ছোট। এত ছোট যে মাইক্রোফোনের নাগাল পেতাম না। ফলে মাইক্রোফোনের নাগাল পেতে আমাকে বালিশের ওপর বসিয়ে দেওয়া হতো।’

নিজের জীবনের স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে একটু কি আর্দ্র হলো অনুপ ঘোষালের গলা! এবার আমরা জানতে চাইলাম সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য প্রসঙ্গে।একটু নড়েচড়ে বসলেন মানুষটি। ওদিকে আলোকচিত্রীর ক্যামেরা তাঁর মুখের ওপর ধরা। ‘আমার মা ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রীর বান্ধবী। সত্যজিতের স্ত্রীর মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। ১৯৬৮ সালের কথা। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ নির্মাণ করবেন সত্যজিৎ। আমাকে ডাকলেন। বললেন, গান শোনাও। শাস্ত্রীয়, রবীন্দ্র, নজরুল মিলিয়ে তাঁকে বেশ কয়েকটি গান শোনালাম। আমার বুক তো দুরুদুরু করছে। এর মধ্যে তিনি বললেন, বাহ্! এ ছেলে তো ভালো গান করে!’

এরপর অনুপ ঘোষাল জানালেন মজার একটি তথ্য, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন-এ গান করার কথা ছিল কিশোর কুমারের। তখন সময় দিতে পারেননি তিনি। ফলে আমার সুযোগ ঘটল। যা-ই বলি না কেন, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান করে একটি প্ল্যাটফর্ম পেলাম আমি। সবাই আমাকে চিনল। পরে হীরক রাজার দেশেতেও গান করেছি। এখানে একটা কথা বলতে চাই, গুপি গাইন বাঘা বাইন মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৯ সালে। তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। তখনই ওই ছবিতে সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেছিলেন, “মহারাজা তোমারে সেলাম/ মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম।”’

নজরুলসংগীতকে জনপ্রিয় করার পেছনে আপনার একটি ভূমিকা আছে...কথাটি শেষ করতে পারিনি। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অনুপ ঘোষাল বললেন, ‘নজরুলকে বরাবরই আমার অন্য রকম বৈচিত্র্যময় মনে হয়। এত প্রতিবন্ধকতা টপকে একজন মানুষ এত দূর যেতে পারেন—ভাবলেই বিস্ময় জাগে!’সেদিন অনুপ ঘোষালের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল আমাদের। নানা কথার ভেতরে তিনি বললেন গুরুপরম্পরার কথা। বললেন, গান গাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না—আরও কত-কী!সব মিলিয়ে অনুপ ঘোষালের সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথাবার্তা শেষে ফিরে আসছি আমরা। ভাবছি, শিল্পী হিসেবে অনুপ ঘোষাল আসলেই কি খুব মেজাজি; তাই কি কাটা কাটা কথা বলেন? হয়তো প্রকৃত শিল্পীরা এমনই হন—গান ছাড়া বোঝেন না কিছুই।