আজম খান কেবল একজন শিল্পী নন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, বাংলা গানের সামাজিক–রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজম খান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা কোনোভাবেই উপেক্ষিত হতে পারে না। তাঁর প্রয়াণের আজ ১০ বছর।
বাংলা গান বা সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যখন আমি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজসহ অনেকে যুক্ত হলাম, তখন বাংলা গানের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। দেশের তরুণসমাজকে এই গান মাতিয়ে তুলল। হাজার হাজার উন্মাতাল তরুণ-তরুণী জড়ো হতে লাগল আমাদের সেই সময়ের কনসার্টে। তবে গানের ভুবনের এই বিস্ময়কর জাদুকর আজম খান বরাবরই ছিলেন সরল–সহজ অতি সাধারণ। জীবনে তাঁর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না, গানই ছিল তাঁর প্রাণ। কোনো অহংকার ছিল না তাঁর। সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। এই সাধারণ জীবনযাপনই তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছিল মানুষের কাছে।
ইতিহাসের অনিবার্যতায় একজন আজম খানের জন্ম হয়েছিল। আজম খান ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস। একদিকে সরল–সহজ সাদাসিধে, অন্যদিকে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে ঘাটতি ছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সাহসী যোদ্ধা আজম খানের গানের মধ্যে। মানুষের সংকটের মুহূর্তে আজম খান তাঁর গানের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা বলেছেন।

আজম খান
সংগৃহীত

সংগ্রাম আর ভালোবাসার মিশেলে তাঁর নতুন ধরনের পরিবেশনার মাধ্যমে সেদিন জেগে উঠেছিল তরুণেরা। গান তাঁর কাছে কেবল আনন্দ-বিনোদন নয়, বরং গান ছিল তাঁর কাছে একজন যুদ্ধফেরত বীর মুক্তিযোদ্ধার কাব্যগাথা। সময়ের সাহসী সৈনিক আজম খান সেদিন যুদ্ধের হাতিয়ার স্টেনগান রেখে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন সমাজসচেতনতার গান। সব প্রতিকূলতা হটিয়ে তারুণ্যদীপ্ত সুরে তিনি শুরু করলেন গানের নতুন ধারা।

ফকির আলমগীর ও আজম খান
সংগৃহীত

‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায়’, ‘অভিমানী’, ‘অনামিকা’, ‘পাপড়ি’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আমি যারে চাইরে’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘ও চাঁদ সুন্দর’, ‘ও রে সালেকা, ও রে মালেকা’, ‘জীবনে কিছু পাব না রে’, ‘বাধা দিও না’সহ বহু গান আজম খানের কণ্ঠে শুনেছে মানুষ। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকে, তখন আমরা দুজনই ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য।আজম খান আমাদের মধ্যে নেই। নেই সংগীতের সাথিদের অনেকেই।

২০১০ সালে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে আজম খানের ৬০তম জন্মবার্ষিকী পালন করার স্মৃতিটা রয়ে গেছে। এর পরের বছর ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি দেশবাসীকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান। এর আগে মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন। কিংবদন্তিতুল্য এই পপসম্রাটের মৃত্যুতে সেদিন কেঁদেছিল বাংলার আকাশ–বাতাস। আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আর কামনা করি, বন্ধু আমার, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো।