পরিবারের ভুলে নজরুলের গানে বিকৃতি নাকি পরিচালকের ইচ্ছায়?

‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির রিমেকের সংগীতায়োজন করেন অস্কারজয়ী ভারতীয় সুরকার এ আর রাহমানকোলাজ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বলিউডে তৈরি হিন্দি ছবি ‘পিপ্পা’য় ব্যবহৃত হয় কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি। আর এ গানের রিমেকের সংগীতায়োজন করেন অস্কারজয়ী ভারতীয় সুরকার এ আর রাহমান। কিন্তু গানে নতুন করে এ আর রহমান সুরারোপ করায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে নজরুল-ভক্তদের মধ্যে। বাংলাদেশ ও ভারতে দাবি ওঠে অবিলম্বে ওই চলচ্চিত্র থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে বিকৃত করে সুর দেওয়া ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটিকে। ১০ নভেম্বর ‘পিপ্পা’ ছবিটি মুক্তি পায় ওটিটিতে।

বাংলাদেশের মতো ভারতীয় গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে শিল্পী সমাজের প্রতিবাদের বিষয়টি গুরুত্বসহ প্রকাশ করছে দুই বাংলার গণমাধ্যমগুলো। অনেকেই সুর বিকৃতের অভিযোগ তুলে এ আর রহমানকে ক্ষমা চাওয়া এবং সিনেমা থেকে গানটি সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আজ সোমবার ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজারে ‘পরিবারেরই ভুলে কি বিকৃতি নজরুল-গীতে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আইনের মারপ্যাঁচে এ বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। কল্যাণী, অনির্বাণদের ভুল বুঝিয়েই চুক্তিটি সম্পন্ন হয় বলে সংশ্লিষ্ট কারও কারও ধারণা।

ঋজু বসুর লেখা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজরুলের সাহিত্যকর্ম (কবিতা) আত্তীকরণ করে একটি রচিত সুরের অংশ হিসেবে পুনর্নিমাণ এবং শব্দ গ্রহণের অনুমতি চেয়েছিলেন ‘পিপ্পা’ ছবির সংশ্লিষ্টরা। ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর সঙ্গে এ বিষয়ে ছবির প্রযোজকদের দুই লক্ষ টাকার চুক্তি হয়েছিল! এ প্রসঙ্গে নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী (কাজী সব্যসাচীর কন্যা) গতকাল রোববার আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, চুক্তির কথা প্রয়াত কল্যাণী কাজী (নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী) এবং তাঁর বড় ছেলে অনির্বাণ ছাড়া কেউ জানতেন না। খিলখিল কাজীর ভাষায়, ‘মনে হচ্ছে আমাদের পরিবারের গাফিলতিতেই “কারার ঐ লৌহ–কবাট”-এর মতো গানের এমন বিকৃতি ঘটছে।’ খিলখিল কাজী এমনও বলেছেন, ‘এসব কারণেই কেউ দাদুর গান ব্যবহার করলে আমরা রেকর্ডিং না শুনে ছাড়পত্র দিই না। যা হয়েছে তা শুধু নজরুল ইসলামকে নয়, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি জাতিকে অপমান!’

এ আর রাহমান
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

চুক্তিপত্রে অনির্বাণ সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন। কল্যাণী ও অনির্বাণের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তাঁদের দুজনকেই নজরুলের একমাত্র উত্তরাধিকারী ধরে নিয়ে ছবির প্রযোজক রয় কাপুর ফিল্মসের পক্ষে চুক্তি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ নিয়ে কথা বলেছেন অনির্বাণের সহোদর কাজী অরিন্দম। তাঁর ভাষ্য এমন, ‘লোকে বলছে, আমরা টাকা নিয়ে দাদুর গান বিক্রি করেছি! এটা অসম্মানজনক। চুক্তির বিষয়ে আমি পুরো অন্ধকারে ছিলাম। আমার মা-ও তখন অতি বৃদ্ধা। ইংরেজিতে লেখা চুক্তির খুঁটিনাটির দায় দাদাকেই (অনির্বাণ) নিতে হবে।’

এ বিষয়ে আজ নজরুল নাতনি অনিন্দিতা কাজী যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের মন্তব্য তুলে ধরেন। ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘আমি অনিন্দিতা কাজী, কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি। দাদুর “কারার ওই লৌহ কপাট” গানটির সুর বিকৃতি ঘটিয়েছেন বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার শিল্পী এ আর রহমান। বিশ্বজুড়ে বিতর্কের ঝড়, তোলপাড়। আমার মা কল্যাণী কাজী, যার বেঁচে থাকাই ছিল নজরুলকে নিয়ে, নজরুলকে ঘিরে, নজরুলকে তিনি ধারণ করেছিলেন...তিনি ২০২১ সালে গানটি অবিকৃত রেখে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানতে পারি। কিন্তু এর পরিণতি এমন হবে, তিনি মৃত্যুর পরেও ভাবতে পারেননি বোধ হয়।’

অনিন্দিতা কাজী
ফাইল ছবি

অনিন্দিতা জানান, সে ক্ষেত্রে ২০২১ সালে কী অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছিল, সেটা জানা খুব প্রয়োজন, তা হলে সব বিতর্কের অবসান হবে এবং যাঁরা অ্যাগ্রিমেন্টের বিপক্ষে গিয়ে এই কাজটি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
অনিন্দিতা আরও লেখেন, মিডিয়ার মাধ্যমেই তিনি জানতে পেরেছেন যে ওই চুক্তির প্রতিলিপি তার ভাই অনির্বাণ কাজীর কাছে রয়েছে। সেটি প্রকাশ্যে আনার অনুরোধ জানান তিনি।

নজরুলের ছেলে অনিরুদ্ধ কাজীর ছেলে কাজী অনির্বাণ আগেই জানিয়েছেন, কল্যাণী কাজী গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও তিনি গানটি রেকর্ডের পর শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে গানটি তাঁর পরিবারকে শোনানো হয়নি, তাঁদের অন্ধকারে রেখেই গানটি প্রকাশ্যে আনা হয়। অনির্বাণ দেওয়ালির পরেই চুক্তিপত্রটি প্রকাশ করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে বিতর্ক শুরুর পরে তিনি অরিন্দমকে চুক্তিপত্রটি পাঠান বলে দাবি করেছেন।

শৈশবে দাদু জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে খিলখিল কাজী। ছবি: সংগৃহীত

আনন্দবাজারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চুক্তিতে নজরুলের সাহিত্যকর্ম বা কবিতার কথাই বলা হয়েছে। গানের কথা নেই। নজরুলের সাহিত্যকর্ম সম্পাদনা, পুনর্বিন্যাস (রিফরম্যাট) ও সংক্ষিপ্তকরণের অনুমতিও নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ।
নজরুল–গবেষক বাঁধন সেনগুপ্তের বক্তব্য দিয়েছেন এ প্রতিবেদনে। তিনি বলছিলেন, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কারাবরণের পরে ১৯২১ সালে তাঁর পত্রিকা “বাঙ্গলার কথা”র জন্য “কারার ঐ লৌহ–কবাট” কবিতা হিসেবে লেখেন নজরুল। বন্ধু মজফফর আহমেদের স্মৃতিকথায় আছে, চিত্তরঞ্জন-পুত্র লেখা চাইতে এলে কয়েক মিনিটে কবিতাটি লিখে দেন নজরুল। এরপর হুগলি জেলে বন্দিদশায় সুর বসিয়ে অমর গানটির সৃষ্টি নজরুলের। ১৯২৪ সালে “ভাঙার গান” বইটিতে “কারার ঐ লৌহ–কবাট”-এর প্রকাশ। ১৯২৪-এর ১১ নভেম্বর বইটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। তা আবার প্রকাশিত হয় স্বাধীন ভারতে, বিদ্রোহী কবি যখন রুদ্ধবাক, অসুস্থ!’
ব্রিটিশ ভারতে বই নিষিদ্ধ হওয়ার ১০০ বছর বাদের এই নভেম্বরে গানটির অমর্যাদায় অনেকেই কষ্ট পাচ্ছেন।