প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানে পথচলার শুরুটা যেমন ছিল

প্রতুল মুখোপাধ্যায়কোলাজ

সৃষ্টিশীল মানুষকে কি অনেকের চেয়ে আলাদা হতে হয়? বসন-ভূষণে পৃথক হতে হয়? কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যদিও বলেছেন, ‘সৃষ্টি করার জন্য, কবিতা লেখার জন্য আলাদা রকমের মানুষ হবার দরকার নেই। লম্বা-লম্বা চুল রাখার দরকার নেই। সর্বক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই।’ তবে কবি, লেখক ও শিল্পীদের অনেকের মধ্যে ‘সাধারণত্ব’ অনুভব করা যায়। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই সাধারণত্বের কথায় স্মৃতিচারণামূলক লেখায় উল্লেখ করেছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতুলের সঙ্গে পরিচয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে সুদীপ লিখেছেন, ‘তিনি নন আতশ কাচের সংগীতবেত্তা। চেনা কিসিমের “ক্রাউড-পুলার”ও তিনি নন। তিনি নন শ্রোতা-কম অভিমানে মঞ্চ ছাড়ার মানুষও। তিনি অসাধারণভাবে সাধারণ।’
প্রতুল সম্পর্কে সুদীপের এই ‘অসাধারণভাবে সাধারণ’ কথার মধ্যেই গ্রথিত আছে প্রতুলের জীবনাচরণ, ভাবনা, ভাবধারা, পৃথিবী দেখার চোখ ও মানব পূজার দর্শন। ১৫ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালে। অবিভক্ত বাংলার বরিশালে।

দেশভাগের পর স্কুলশিক্ষক বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও গৃহবধূ মা বীণাপাণি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাড়ি জমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ক্লাস ফোরের আগে কোনো স্কুলে তিনি পড়েননি। তারপর যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেন, সেই দিনগুলোও ছিল অন্য রকম। খালি পায়ে স্কুলে যেতেন। পা দুটি ধুলায় মাখামাখি হয়ে যেত। পায়ের ওপর পা ঘষে পা পরিষ্কার করে নিতেন। গায়ে একটা ইজের (ইজের হচ্ছে বোতামটোতাম না, দড়ি দিয়ে বাঁধা) দেওয়া জামা যদিও থাকত; কিন্তু নিচে গেঞ্জি থাকত না। ক্লাস সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত এভাবেই স্কুলে গেছেন প্রতুল। সাধারণ সারল্যময় শৈশব। এক সাক্ষাৎকারে নিজেও এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘এখন হয়তো একটা ভালো পোশাক-টোশাক পরি। কিন্তু শৈশবের সেই আবরণ এখনো আমার মধ্যে রয়েছে। খুব সহজভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলা, নিজের মনটাকে মানুষের সামনে একবারে খুলে দেওয়া—এই জিনিসগুলো কিন্তু এখনো আছে। সেটা হয়তো আমরা যেভাবে মানুষ হয়েছি, সেই আবহের জন্য হয়েছে।’

প্রতুল মুখোপাধ্যায়
ফাইল ছবি

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘সাধারণ’ হয়ে ওঠা, আজীবন  নিজেকে ‘সাধারণ’ রাখার প্রচেষ্টার আপাত একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। কিন্তু গান লেখার প্রেরণা; কেন গান লিখতে এলেন তিনি? ধরাবাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক সংগীতের শিক্ষা তিনি নেননি।

পাখির ডাক থেকে শুরু করে যে ভিখারি সকালবেলা কীর্তন গাইত, শ্যামা গান গাইত, বাবার সঙ্গে বসে যে শিল্পী বেহালা বাজাতেন এবং গাইতেন তাঁরাই তাঁকে সংগীতে এনেছেন বলে মনে করতেন তিনি। বলতেন, ‘এদের গলা, এদের গানগুলো আমি গলায় তুলেছি।’ ভালোবেসে গান গাইলেও বিরাট একজন সংগীতজ্ঞ হবেন, সবাই তাঁকে দেখার জন্য ছুটে আসবেন, এমন ভাবনা তাঁর ছিল না। তবে একটি বইয়ের কথা বলতেই হবে, যে বইটি হাতে না পেলে তাঁর সুর সৃষ্টির প্রতিভা বিকশিত হতে আরও বেশি সময় লাগতে পারত। বইটা তাঁর দাদা তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। বইটি ছিল একটি ছড়া কবিতার বই। বইটিতে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও বিষ্ণু দে—এই চার কবির কবিতা এবং ছড়া ছিল। বইটা হাতে পাওয়ার পর থেকে নিয়মিত পড়তেন। ছড়া-কবিতাগুলো পড়ে আরাম পেতেন। আর পড়তে পড়তেই ১২ বছর বয়সে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ধান কাটার গান গাই, লোহা পেটার গান’—কবিতাকে সুর দিয়ে গানে রূপ দেন তিনি। আরও অবাক করা ব্যাপার, ১২ বছর বয়সে করা সুরেই ১৯৯৪ সালে গানটা রেকর্ড করেন।

কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়কেও রেকর্ডটা প্রতুল শুনিয়েছিলেন। নিজের কবিতা সুরে শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন মঙ্গলাচরণ। ‘তুমি খালি এটা করছ কেন, আমার আরও কত কবিতা আছে, সেগুলোও করো।’

প্রতুল মুখোপাধ্যায়
ভাস্কর মুখার্জি

পত্রপত্রিকায় দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, স্কুলে পড়াকালীন নাটকেও অভিনয় করতেন প্রতুল। তখন স্কুলে প্রায়ই নাটক হতো। নাটকে নির্দেশনা দেওয়া শিক্ষক কখনো কখনো নাটক থেকে গান বাদ দিতে চাইতেন। কিন্তু প্রতুল বাধা দিতেন। বলতেন, আমি গাইব, গান বাদ দেবেন না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গায়ক চরিত্রেই অভিনয় করতে হতো তাঁকে। সুর দেওয়া কঠিন না সহজ, সুর দিতে তিনতলা চারতলা সুর পেরোতে হয়—এসব নিয়ে ভাবনা ছিল না প্রতুলের। অকৃত্রিমভাবে ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো স্বাভাবিকভাবেই গানকে নিজের সত্তায় পেয়েছিলেন তিনি। দেহান্তর হলেও তাঁর গানে তিনি থেকে যাবেন দুই বাংলায়, মানুষের হৃদয়ে।