মেলোডি কিং প্রণব ঘোষ, আমরা দাদাকে কিছুই দিতে পারিনি

অনেক জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা গানের সুরকার প্রণব ঘোষকোলাজ
আধুনিক বাংলা গানের সুরের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রণব ঘোষ। ‘আমি সবকিছু ছাড়তে পারি’, ‘অনুশোচনা’, ‘পৃথিবীর মতো হৃদয়টাকে’, ‘জীবনের গল্প একটাই’, ‘যদি কখনো জানতে পারো’, ‘এ মন আমার পাথর তো নয়’, ‘মরণ যদি হয় তোমার প্রেমের আঘাতে’, ‘এ আমার শেষ চিঠি’, ‘ফুল যত সুন্দর হোক না কেন’, ‘এই সেই বুকের জমিন’, ‘বিষম পিরিতি’, ‘দেখলে তোমায়’, ‘আকাশ হারায় নীল’, ‘লোকে আমায় পাগল বলে’, ‘অনেক বেদনাভরা আমার এ জীবন’সহ আরও অসংখ্য গানের সুরকার তিনি। গুণী এই সংগীত ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লিখেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত গীতিকবি কবির বকুল

১৯৯০ সালের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স করছি। ইতিমধ্যেই আমার লেখা দুটি গান বেরিয়েছে। প্রথম গানটি ছিল ‘কাল সারা রাত তোমারই কাঁকন'। গানটি সুর করছিলেন এবং গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এটি বাচ্চু ভাইয়ের প্রথম অ্যালবাম ‘ময়না’র গান। ১৯৮৮ সালে অ্যালবামটি (ফিতাবন্দী ক্যাসেট) বেরিয়েছিল ‘সারগাম’ থেকে। দ্বিতীয় গানটি ছিল ‘পথে যেতে যেতে খুঁজেছি তোমায়'।
ভাষাতত্বের ক্লাসগুলো হতো কলাভবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদিনের ক্লাস শেষ করে আমি ‘কিঞ্চিৎ’ বাসে চড়ে মৌচাক মার্কেটের সামনে নেমে যেতাম। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে যেতাম বিজয় নগর সারগাম স্টুডিওতে। ওই সময় সব শিল্পী ও সুরকারদের আড্ডার স্থল ছিল সারগাম। অধিকাংশ অ্যালবামের কাজ হতো ওখানে। আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল গানের ডায়েরি নিয়ে সারগামে যাওয়া এবং বিভিন্ন সুরকার ও শিল্পীদের আমার লেখা গান (গীতিকবিতা) দেখানো। প্রমাণ হিসেবে সবাইকে তখন আমি ইতিমধ্যেই বের হওয়া ওই দুটি গানের কথা বলতাম। আমার গান পছন্দ হলে কেউ কেউ নিতেন। কিন্তু ওই নেওয়া পর্যন্তই। দিনের পর দিন যতগুলো গান আমি ওই সময় বিভিন্ন শিল্পী ও সুরকারকে দিয়েছি, তার একটিও ক্যাসেট ফিতাবন্দী হয়ে আসেনি। একসময় আমাকে হতাশায় পেয়ে বসে। কিন্তু প্রতিদিন দুপুরে সারগাম স্টুডিওতে যাওয়ার অভ্যাসটা বদলায়নি। একদিন দুপুরে সারগামে গিয়েছি। যেতেই দেখা হয়ে যায় শিল্পী শেখ ইশতিয়াক ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি ইতিমধ্যে আমার লেখা দুটি গান পছন্দ করে নিয়েছিলেন। দেখা হতেই বললেন, বকুল, তোমার গানগুলো নিয়ে এখনো বসতে পারিনি। তখনই রেকর্ডিং শেষ করে স্টুডিও থেকে বেরিয়েছেন দীর্ঘকায় একজন মানুষ।

শেখ ইশতিয়াক তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করার ফাঁকে বললেন, দাদা, ও বকুল। গান লেখে। আমিও ওর গান নিয়েছি। আপনি ওর গান দেখতে পারেন। সেদিনই প্রথম আমার পরিচয় ঘটল প্রণব ঘোষের (দাদা) সঙ্গে। আমি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমার গানের ডায়েরিটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর বললেন, সন্ধ্যায় পূর্ব রাজাবাজার মসজিদের পাশে আমার বাসা। তুমি সন্ধ্যায় আসো। তখন গানগুলো দেখব। প্রণব ঘোষ চলে গেলেন। আমার ভেতরে চরম উত্তেজনা। কখন সন্ধ্যা হবে।

স্টুডিওতে কুমার শানু, আজম বাবু, প্রণব ঘোষ এবং কবির বকুল
ফেসবুক থেকে

সন্ধ্যা সাতটায় আমি দাদার দেওয়া ঠিকানানুযায়ী পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়ি। দাদার গানের রুমে ফ্লোরিং করা কার্পেটের ওপর বসতে বসতেই দেখলাম, দাদা একজনকে নিয়ে গানের কাজ করছেন। দাদা পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তাঁর নাম বলতেই আমি বসা থেকে দাঁডিয়ে গেলাম। তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। সেই গীতিকবির নাম মাসুদ করিম, একজন সজ্জন মানুষ। তাঁর লেখা অসংখ্য গান (তন্দ্রাহারা নয়ন আমার, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো, যখন আমি থাকব না কো, যখন থামবে কোলাহল, শত্রু তুমি বন্ধু তুমি, শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাব, সন্ধ্যারও ছায়া নামে, যে বাঁশি ভেঙে গেছে) তখন ভীষণ জনপ্রিয়। মাসুদ করিম ভাই প্রণব দার সঙ্গে কাজ শেষে বিদায় নিলেন।
এরপর দাদা বসলেন আমার সঙ্গে। ডায়েরি ঘেঁটে নিজেই পছন্দ করলেন আমার লেখা বেশকিছু গান। তিনি বলেন, তাঁর ডায়েরিতে তুলে দিতে। আমি লিখতে বসে গেলাম। হঠাৎ দাদা বললেন, বকুল, তুমি কি সুরের ওপর গান লিখতে পারবে। আমি যেহেতু তখন পর্যন্ত বিভিন্ন মঞ্চে গান গাইতাম, তাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, পারব। তিনি হারমোনিয়ামে একটি সুর বাজিয়ে শোনালেন। খুব বেশি সময় লাগল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই লিখে ফেললাম, ‘রাত অনেক হলো বেশি, পৃথিবীটা ঘুমে এখন/ তোমার কথা ভাবতে গিয়ে সময় কেটে গেছে কখন।’

দাদা সুরের সঙ্গে মিলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘একদম ঠিক আছে। কাল থেকে তুমি প্রতি সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবে।’ সুরের ওপর যে গানটি লিখলাম, দাদা বললেন, ‘আমি জেন্টল বয়েজ নামের একটি ব্যান্ডের অ্যালবামের কাজ করছি। গানটি সেই অ্যালবামে যাবে।’

১৯৯০ সালের আগষ্ট মাসে কোনো একদিন শুরু হলো প্রণব ঘোষের সঙ্গে কাজ করা। দাদা তখন যেই অ্যালবামের কাজ করতেন, সেই অ্যালবামে আমার গানও থাকত। দাদার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি একটা লিরিক হাতে পেলে, প্রথমে পড়তেন, পছন্দ হলে সামনে রাখা হারমোনিয়ামের টপউডের ওপর রেখে সা পা সা ধরেই তিনি সুর করে ফেলতেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আর দাদার সুরগুলো হতো ভীষণ মেলোডিয়াস। (পরবর্তী সময়ে তাঁকে মেলোডি কিংও বলা হতো)
১৯৯০ সালেই বের হয় জনপ্রিয় শিল্পী শুভ্র দেবের ‘ছোঁয়া’ অ্যালবামটি। সবগুলো গানই মাসুদ করিমের লেখা, প্রণব ঘোষের সুর। অডিও ক্যাসেটটি খুব ব্যবসাসফল হয়। এরপরই শুভ্র দেবের পরের অ্যালবামের কাজ শুরু করে দেন প্রণব দা। প্রতিদিনের এক সন্ধ্যায় গেলাম দাদার বাসায়। নতুন কি লিখেছি, জানতে চান দাদা। আমি বেশ ক‘টি মুখ দাদাকে দেই। দাদা সেখান থেকে দুটি গানের মুখ নিয়ে সুর করেন। তারপর সেই সুর মিনি ক্যাসেট রেকর্ডারে রেকর্ড করে আমাকে বললেন, অন্তরা পরে করব। আগে তুমি এই গানটা লেখো। তিনি আমাকে একটা সুর দিলেন। আমি বসে গেলাম সুরের ওপর সেই গানটা লিখতে। একটু পরই লিখলাম—তুমি জীবনে তুমি মরণে তুমি আমার হৃদয়ে রয়েছ সবখানে।

দাদা লিরিকটা সুরের সঙ্গে মিলিয়ে বললেন, ঠিক আছে। অন্তরা লেখ। এ গানটি শুভ্র দেবের নতুন অ্যালবামে যাবে। আমি ভেতরে ভেতরে ভীষণ রোমাঞ্চিত। কারণ, শুভ্র দেব তখন অনেক জনপ্রিয় শিল্পী। এর কয়েক দিন পর আমি নিজ বাড়ি চাঁদপুরে গিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল তাই। যেদিন গেছি, সেদিন রাতেই বাসার টি অ্যান্ড টি নাম্বারে দাদা কল করলেন। ফোনে আমাকে পেয়ে বললেন, রাতের লঞ্চেই শিগগিরই ঢাকা আসো। তোমার লেখা একটা মুখ সেদিন সুর করে রেখেছিলাম, ওটা শুভ্র দেব খুব পছন্দ করেছেন। তুমি কাল এসে অন্তরা লিখে দাও। আমরা পরশু কলকাতা যাচ্ছি গানগুলো রেকর্ড করতে।

আমি রাতের লঞ্চেই উঠে গেলাম। সকালে সোজা দাদার বাসায় হাজির। তারপর বসে শেষ করলাম ‘ফুল যত সুন্দর হোক না কেন, ফুলেরই পাশে যদি থাকো/ আমি চেয়ে চেয়ে তোমাকেই দেখব, স্বপ্নের আবিরে তোমাকে রাঙাব, লজ্জাতে মুখ কেন ঢাকো।’

শুভ্র দেবের ‘শেষ চিঠি’ অ্যালবামের প্রথম গান ছিল এটি। ‘তুমি জীবনে তুমি মরণে’ গানটি তো ছিলই। ‘শেষ চিঠি’ বের হয় ১৯৯১ সালের ঈদুল ফিতরে। ওই বছর সবচেয়ে ব্যবসাসফল অডিও অ্যালবাম ছিল এটি। সেই থেকে প্রণব ঘোষের কপালে তিলক লেগে গেল হিট মেশিন। তাঁর বাড়িতে শিল্পীদের লাইন লেগে গেল। যাঁরই অ্যালবামে প্রণব দা হাত দেন, সেটিই ব্যবসাসফল। ১৯৯১ সাল থেকে আমাকে আর বসে থাকতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে আমিও ব্যস্ততম গীতিকবি হয়ে গেলাম। ১৯৯১ সালেই আমার সৌভাগ্য হলো কলকাতায় যাওয়ার। সেই গল্পটাই করি।

আমি তখন থাকি শিল্পী তপন চৌধুরীর সঙ্গে, মালিবাগ সার্কুলার রোডে। বলে রাখা ভালো, আমার গীতিকবি হয়ে ওঠার ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছিল তপন চৌধুরীর হাত ধরেই। এই গল্প আরেক দিন করব। ১৯৯১ সালে তপন চৌধুরীর অ্যালবামের কাজ চলছে। অনেকেই সুর করেছেন এই অ্যালবামে। নকীব খান, শেখ সাদী খান। তবে অ্যালবামের ছয়টি গানের সুর করেন প্রণব ঘোষ। পুরো অ্যালবামের আদনান জামিল ঝুলনের তত্ত্বাবধানে হয়। তো সিদ্ধান্ত হলো প্রণব দা যে ছয়টি গান করেছেন, এই গানগুলোতে অ্যাকুইস্টিক ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করলে গানগুলো ভালো হবে। তাই গানগুলো কলকাতায় রেকর্ড হবে। দাদার সুর করা ছয়টি গানের মধ্যে তিনটিই ছিল আমার লেখা। আমিও আগ্রহ দেখালাম কলকাতা রেকর্ডিংয়ে যেতে চাই। তপন দা ঝুলনকে বললেন, বকুলও যাবে। আমি পাসপোর্ট করলাম এবং একদিন প্রণব ঘোষ, তপন চৌধুরী ও ঝুলন উড়াল দিলাম কলকাতার পথে। আমি আর তপন দা উঠলাম গাঙ্গুলি বাগানে, তপন দার বোন কল্যাণী দির বাড়িতে। আর প্রণব দা ও ঝুলন উঠলেন হোটেলে।

রবী চৌধুরী, প্রণব ঘোষ ও তপন চৌধুরী
ফেসবুক থেক

সেই প্রথম আমার দেশের বাইরে যাওয়া। সন্ধ্যায় আমরা গেলাম এই ছয়টি গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জ যিনি করছেন—সমীর খাশনবীশ, তাঁর বাড়িতে। দাদা সমীর দার সঙ্গে গানগুলো নিয়ে বসলেন। পরদিন এই গানগুলোর মিউজিক ট্র্যাক হবে অডিও সেন্টার স্টুডিওতে। আমরা গিয়ে দেখি, আমাদের আগেই প্রণব দা স্টুডিওতে গিয়ে বসে আছেন। প্রণব দাদার আরেকটি বড় গুণ, তিনি খুবই সময়ানুবর্তী ও সিনসিয়ার মানুষ। কখনো কোনো রেকর্ডিংয়ে তাঁর আগে কেউ স্টুডিওতে আসতে পারেননি। আর তাঁর কাজগুলো সব গোছানো। যাঁর গান করেন, তাঁর জন্য আলাদা একটা গানের খাতা। সেই খাতায় শিল্পীর জন্য সুর করা প্রতিটি গানই তিনি নিজ হাতে লিখে দিতেন। দাদার হাতের লেখাও ছিল মুক্তার মতো সুন্দর।

সেদিন স্টুডিও থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল বিখ্যাত সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে তপন দার পূর্ব পরিচয় থাকায় আমরাও তাঁর সৌজন্য সাক্ষাৎ পেলাম। এর পরদিন ভয়েজ রেকর্ডিং। তপন দা প্রণব দার সুরে প্রথম গান গাইছেন। এক শিফটে ছয়টা গান। প্রণব দা বেশ খুঁতখুঁতে। একদম ১০০ ভাগ গায়কি না পেলে তিনি ওকে করছিলেন না। এ জন্য বেশ সময় লাগলেও তপন দা ছয়টি গানই সেদিন গেয়ে ফেললেন।

১৯৯১ সালের ঈদুল আজহায় এই অ্যালবাম সংগীতা থেকে আসে। শিরোনাম ছিল ‘তোমার জন্য’। এই অ্যালবামে আমার লেখা তিনটি গান ছিল—তাজমহলের সেই মমতাজ নও, এখনো হয় ভোর শিশির ছড়ায় ঘাসে, চাঁদ তারা নদী ফুল আকাশ বলো।

১৯৯৪ সালের কথা। হিন্দি চলচ্চিত্রে তখন প্লেব্যাকে অন্য উচ্চতায় চলে গেছেন একজন শিল্পী। তিনি কুমার শানু। সে বছর প্রথমবারের মতো একটি শোতে গান গাইতে ঢাকা আসছেন কুমার শানু। প্রণব দা জরুরি ভিত্তিতে তাঁর বাড়িতে আসতে বললেন। গান নিয়ে বসতে হবে। আমি সন্ধ্যায় চলে গেলাম দাদার বাসায়। দাদা বললেন, একজন বিখ্যাত শিল্পীর জন্য ১০টা গান করতে হবে। ফটাফট গান লিখে দাও। কিন্তু শিল্পী কে তা বললেন না। একটু পর দেখলাম, এক এক করে মিলন খান, কামরুজ্জামান কাজল, আহমেদ রিজভীও এসে হাজির। দাদা আমাকে যা বলেছিলেন, একই কথা সবাইকে বললেন। সবাই গান গান লিখতে বসে গেলেন। এ যেন গান লেখার প্রতিযোগিতা। আমি হয়তো লিখে দিলাম। দাদা সঙ্গে সঙ্গে সেটি সুর করে রেকর্ড করে ফেললেন। এভাবে সেই রাতেই দাদা ১০টি গান তৈরি করে ফেললেন। রিদম প্রোগ্রামিং করতে রাতেই দাদার বাড়ি চলে এলেন লিটন ডি কস্টা। আমরা সবাই বাড়ি ফিরে গেলাম। পরদিন অডিও আর্টে মিউজিক ট্র্যাক। তার পরদিন যে শিল্পীর জন্য গান, তাঁর ভয়েজ রেকর্ড। দাদা, আমাকে শুধু বললেন, এটি সাউন্ডটেকের প্রজেক্ট। আর শিল্পীর নাম কুমার শানু। দাদাকে খুব করে ধরলাম, বললাম, আমি এই শিল্পীর একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। (আমি তখন দৈনিক ভোরের কাগজে কাজ করি)

দাদা বললেন, কাজটা খুব গোপনীয়। কারণ, তিনি শো করতে আসছেন। গান রেকর্ড করার কথা জানাজানি হলে করের ঝামেলা আছে। তাই রেকর্ডিংয়ে কেউ থাকতে পারবেন না। আমি নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া গেল। আমরা সকাল ১০টা থেকে অডিও আর্টে বসে আছি। কুমার শানু আসবেন। তিনি এলেন বেলা সাড়ে ১২টায়। সঙ্গে কুনিকা সদানন্দ (বলিউড অভিনেত্রী) তাঁর বান্ধবী।সকালের ফ্লাইটে ঢাকা এসেছেন। উঠেছেন পাঁচ তারকা হোটেলে। লাগেজ রেখেই স্টুডিওতে চলে এসেছেন। আগের দিনও শো ছিল। তাই তিনি ভীষণ ক্লান্ত। এসেই ঘোষণা দিলেন, তিনি গান আজ গাইতে পারবেন না, গলা বসে আছে। প্রণব দার মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি দুই রাত জেগে ১০টি গান করেছেন, এখন কিনা শিল্পী কণ্ঠ দিতে পারবেন না! প্রণব দা অন্য পন্থা নিলেন। তিনি কুমার শানুকে বললেন, ঠিক আছে, আজ বিশ্রাম নিন। দুপুরে আমাদের সঙ্গে খান। পরে আপনার সময় পেলে আমরা ভয়েজ রেকর্ড করব না হয়। তারপর শুরু হলো আড্ডা। কথায় কথায় দাদা, শানু দাকে বললেন, এত কষ্ট করে গানগুলো করেছি, না গাইলেন, অন্তত গানগুলো একটু শুনুন। কুমার শানু সম্মতি দিলেন। প্রণব দা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে উঠলেন, শিল্পীর জন্য গান কবির জন্য কবিতা, আমার জীবনে যাকে প্রয়োজন, পাইনি আজও তাঁর দেখা, আমি একা বড় একা। দাদার সঙ্গে কুমার শানুও সুর মেলালেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রণব দা বললেন, বাহ, আপনি তো আপনি তো দারুণ তুলে ফেললেন। একবার মাইক্রোফোনে দাঁড়াবেন কি? শানু দা আধশোয়া ছিলেন। তিনি উঠে পড়লেন। বললেন, ভয়েস রুমটা কোন দিকে। কুমার শানু ভয়েজ রুমে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। হেডফোন পরে নিয়ে ডান হাঁটু সামনে ভাঁজ করে ফেললেন, আর বাঁ পা পেছনের দিকে ঠেলে দিলেন। বাঁ কানে হাত দিয়ে ইশারা করলেন ট্র্যাক ছাড়তে। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আজম বাবু প্রণব দার ইশারায় ট্র্যাক অন করলেন। পুরো ট্র্যাকের সঙ্গে গানের লিরিকটা একবার দেখে নিলেন শানু দা। দ্বিতীয়বার এক টেকে গান ওকে। আমরা উপস্থিত সবাই বিস্মিত।

এরপর কুমার শানু আবার ফিরে গেলেন বিশ্রাম কক্ষে। দাদা আবারও হারমোনিয়ামে দ্বিতীয় গানটি ‘আকাশ জানে সাগর জানে আমারই শুধু যে তুমি’ গেয়ে শোনালেন। শানু দাও সুরটা তুললেন এবং আবারও দাদার অনুরোধে ভয়েজ রুমে চলে গেলেন। একই দৃশ্যর অবতারণা হলো। আমরা উপস্থিত সবাই দ্বিতীয়বার বিস্মিত হলাম। এবাবেই দাদা সেদিন কুমার শানুকে দিয়ে ছয়টি গান গাইয়ে নিলেন। আর ছয়টির মধ্যে প্রথম দুটি গানই ছিল আমার লেখা।  

১৯৯১ সালে শুভ্রদেবের ‘শেষ চিঠি’ অ্যালবামটি তুমুল হিট হওয়ার পর থেকেই প্রণব দার বাড়িতে শিল্পী ও অডিও কোম্পানিগুলোর ভিড় লেগে যায়। যদি হিসাব করি, তবে ১৯৯১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত টানা বারো বছর অডিও ইন্ড্রাস্ট্রি রাজত্ব করেছেন প্রণব ঘোষ। এবার বছরে সব চাইতে বেশি ব্যবসাসফল অ্যালবাম দিয়েছেন প্রণব ঘোষ। তাঁর সুর করা অ্যালবাম দিয়েই অনেক অডিও প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে, অনেক শিল্পীই পেয়েছেন তারকাখ্যাতি।

এই এক যুগ প্রণব ঘোষের সুরে ব্যবসাসফল অ্যালবামগুলো হলো শুভ্র দেবের শেষ চিঠি, বুকের জমিন, আমার ভালোবাসা, সাদা কাগজ। তপন চৌধুরীর আমার পৃথিবী, অনুশোচনা। ডলি সায়ন্তনী–কালিয়া, বিরহী প্রহর, এক জনমে। রবি চৌধুরীর এক নয়নে কান্দো, পাশাপাশি। এস ডি রুবেলের বেদনার বালুচর, কেউ নেই, শুধু একবার। মিশ্র অ্যালবাম–অন্তরে তুমি, তুমি পাশে নেই, নীরব চিঠিসহ আরও অসংখ্য অ্যালবাম।

প্রণব ঘোষের সুরে জনপ্রিয় গানগুলো হলো ‘আমি সবকিছু ছাড়তে পারি’, ‘অনুশোচনা’, ‘পৃথিবীর মতো হৃদয়টাকে’, ‘প্রিয়ার মনের কথা’, ‘জীবনের গল্প একটাই’, ‘যদি কখনো জানতে পারো’, ‘এ মন আমার পাথর তো নয়’, ‘মরণ যদি হয় তোমার প্রেমের আঘাতে’, ‘এ আমার  শেষ চিঠি’, ‘ফুল যত সুন্দর হোক না কেন’, ‘এই সেই বুকের জমিন’, ‘সাদা কাগজের পাতায় পাতায়’, ‘বিষম পিরিতি’, ‘দেখলে তোমায়’, ‘আকাশ হারায় নীল’, ‘লোকে আমায় পাগল বলে’, ‘অনেক বেদনাভরা আমার এ জীবন’, ‘অন্তরে আছ তুমি আমার’সহ আরও অসংখ্য গান।

প্রায় এক যুগ আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল অ্যালবাম উপহার দিয়েছেন, তিনি প্রণব ঘোষ। তাঁর সুরে একটি গান গাওয়ার জন্য, তাঁর সুরে একটি গান লেখার জন্য তাঁর বাড়িতে বছর দুয়েক আগেও ছিল দেশের জনপ্রিয় শিল্পী-গীতিকারদের ভিড়। হঠাৎ কাজ কমে যাওয়ায় দাদার বাড়িতে কমে যায় সবার পদচারণা।

আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়। ২০০৭ এ জানুয়ারি মাসের কথা। আমি চলচ্চিত্রে গান লেখায় ভীষণ ব্যস্ত। গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আক্তার একদিন ফোনে বললেন, তাঁর নতুন চলচ্চিত্র ‘মেঘের কোলে রোদ’–এর গান নিয়ে বসতে চান। আর তিনি সুরকার হিসেবে চিন্তা করছেন প্রণব ঘোষের কথা। দাদার নাম শুনেই আমি বললাম, খুব ভালো। দাদার সঙ্গে অনেক দিন কাজ করা হয়নি। বলুন কবে বসবেন। পরদিনই আমরা নার্গিস আক্তারের ধানমন্ডির বাসায় বসলাম। দাদার সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা হলো। ছবির গল্প শোনানো হলো।

প্রণব ঘোষের সামনে বসে সুরের উপর গান লিখছেন কবির বকুল
ফেসবুক থেকে

দাদা বললেন, ফটাফট লিখে দাও গান। প্রথম সিটিংয়েই আমি লিখলাম, ‘বল না কেন ওই আকাশ নেমে আসে সাগরের বুকে/বল না কেন ওই ঝরনা নদী খোঁজে কিসেরই সুখে/ সব কথা বলে না হৃদয়/ কিছু কথা বুঝে নিতে হয়’। দাদাও অসম্ভব সুন্দর মেলোডিয়াস সুর করলেন। এরপর আরও দুই দিন বসে ছবির সব কটি গান লিখে দিলাম। দাদাও সুর করে ফেললেন। আমরা রেকর্ডিংয়েও চলে গেলাম। ‘মেঘের পরে রোদ’ ছবির প্রতিটি গানই দারুণ হলো। আর কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, দাদা সেই আগের মতোই সিনসিয়ার, সময়জ্ঞানসম্পন্ন নিবেদিতপ্রাণ সংগীত পরিচালক।

কাজের ফাঁকে জানলাম। দাদার হাতে কোনো কাজ নেই। এক যুগ যিনি অডিও ইন্ড্রাস্ট্রি শাসন করেছেন, তাঁর হাতে কাজ নেই। যে শিল্পীদের কণ্ঠে তিনি তুলে দিয়েছেন সুপারহিট গান, তাঁরা কেউ না কি এখন আর তাঁর খোঁজও নেন না। এসব খবর জেনে খুবই অনুশোচনা হলো। কারণ, আমিও তো সেই দলের একজন। গত কয়েক বছর আমিও দাদার খবর নিতে পারিনি। আমার সেই অপরাধবোধ থেকেই দাদার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতে লাগল আবার। জানলাম, একটা অডিও অ্যালবামের কাজ পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘সবগুলো গান যদি আমি লিখে দিই, তবে অ্যালবামটা তিনি করতে পারবেন।’ কিন্তু তার আগেই দাদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি জন্ডিসে আক্রান্ত। ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই গোপনে তাঁকে ভর্তি করানো হলো মনোয়ারা হাসপাতালে। (দাদা, বউদিকে (সাবিহা চৌধুরী চম্পা) বলেছেন, তাঁর অসুস্থতার খবর কাউকে না জানাতে)। আমি খবর পেলাম ৪ আগস্ট। তারপর থেকে প্রতিটি দিনই আমি ছুটে গেছি হাসপাতালে। সবাইকে জানিয়েছি দাদার অসুস্থতার খবর। কিন্তু তেমন কাউকে আমি ছুটে আসতে দেখিনি। দেখেছি, দাদা যেদিন চলে গেলেন, (১৬ আগস্ট, ২০০৭) সেদিন রাতে এবং তার পরদিন অডিও আর্টে দাদার জানাজায় (দাদা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, মোহাম্মদ শফি প্রণব)।
প্রণব ঘোষের সঙ্গে আমার শেষ কাজ ছিল ‘মেঘের কোলে রোদ’ ছবির গান। আর এই ছবির ‘সব কথা বলে না হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়’ এ গানের জন্য ২০০৮ সালে আমি প্রথম শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পাই। দাদা, আমাদের শুধু দিয়ে গেছেন। আমরা দাদাকে কিছুই দিতে পারিনি।