সানির গানের শহর, শহরের গান

এক যুগের ক্যারিয়ারে গানের কথা-সুরে শহরকে তুলে ধরেছেন নির্মাতা, গীতিকবি, সুরকার ও সংগীতশিল্পী আহমেদ হাসান; তাঁকে শ্রোতারা সানি নামে চেনেন। মৌলিক গানের পাশাপাশি বব ডিলান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও সুরে বেঁধেছেন তিনি। ‘শহরের দুইটা গান’, ‘হয়তো আমরা’-এর মতো আলোচিত গান গেয়েছেন এই শিল্পী।

সানিছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

কবি আল মাহমুদের ‘আমি আর আসবো না বলে’ কবিতার সঙ্গে মুয়ীজ মাহফুজের ‘ঝরুক সন্ধ্যা কদম্বতলে’ জুড়ে ‘শহরের দুইটা গান’ বেঁধেছেন সানি। কবিতাজুড়ে ‘দুধের ওপরে ভাসা সর’-এর মতো ছড়িয়ে থাকা অভিমানকে বিষাদের সুরে প্রাণ দিয়েছেন তিনি। বুক বিদীর্ণ করা সুরে সানি গেয়েছেন, ‘পাখি, আমি আসবো না/ নদী, আমি আসবো না/ নারী, আমি আসবো না।’ গত বছরের শেষভাগে হাতিরপুল সেশনস থেকে প্রকাশিত ‘শহরের দুইটা গান’ তরুণ হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছে।
গত রোববার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সানি জানান, আল মাহমুদের কবিতাটি আগেও পড়েছেন। এক বৃষ্টির দিনে আরেকবার পড়তে গিয়ে কবিতাটি তাঁকে আক্রান্ত করেছে। সানি বলেন, ‘সেই দিন বাসায় ফিরে গিটার নিয়ে বসে সুরটা করে ফেলি। তখন ভাবছিলাম, সাহিত্য, কবিতা, গান, শিল্পকর্ম এতটা জোর দিয়ে করি; কারণ, আমরা আর ফিরে আসব না।’

বব ডিলান কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও শরণ নিয়েছেন সানি। বব ডিলানের বিখ্যাত গান ‘ফরএভার ইয়ং’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সানি লিখেছেন ‘চিরকাল নবীন’, গানটি বছর পাঁচেক আগে গেয়েছেন তিনি। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ ভৈরবী’ কবিতায় সুরের মায়াজাল ছড়িয়েছেন সানি; সুরে সুরে ‘বর্ষাপীড়িত ফুল’-এর সুবাস ছড়িয়েছেন তিনি। সানির গায়কির প্রশংসা করেছেন ভারতীয় শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক, কলকাতার কনসার্টে ‘চিরকাল নবীন’ গেয়েছেন মৌসুমী।
জীবনানন্দ দাশের ‘পাখিরা’, আহমদ ছফার ‘কে আর বাজাতে পারে’ কবিতাকে সুরে বেঁধেছেন সানি। কবিতার পাশাপাশি সানিকে মৌলিক গানেও পাওয়া গেছে। ‘আমরা হয়তো’, ‘আমারে উড়াইয়া দিয়ো’-এর মতো গান নিজে লিখেছেন সানি। নিজের সুরেই বেশির ভাগ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।

সানি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

গানের শহর, শহরের গান
সানির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ঘুরেফিরে তাঁর গানজুড়ে এই শহর জড়িয়ে আছে। নাগরিক জীবনকে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছেন সানি, গানেও সেটার ছাপ রয়েছে। সানির ভাষ্যে, ‘শহরটা আমার কাছে অন্যভাবে ধরা দিয়েছে। আমি বাইরে থেকে এলে শহরকে অন্যভাবে দেখতাম। কিন্তু আমার রক্তাক্ত হওয়ার জায়গাও এটা, বেড়ে ওঠার জায়গাও এটা। আমি এটাকে অন্তর্গতভাবে দেখতে পারি।’

‘শহরের দুইটা গান’ প্রকাশের আগে ‘শহরের গান’সহ বেশ কয়েকটি গানে শহরকে ধরেছেন সানি। শহুরে সোডিয়াম রাত, সিগন্যাল বাতি কিংবা ট্রাফিক—রোজকার নাগরিক জীবনকে গানে বেঁধেছেন তিনি। এর বাইরে ‘আমারে উড়াইয়া দিয়ো’ গানে বিশ্বনাগরিক হতে চাওয়ার আকুলতা জানিয়েছেন সানি। স্বপ্নজাল সিনেমার গানটি প্রকাশ্যে আসার পর শ্রোতৃমহলে সাড়া ফেলেছিল।
সংগীতজীবনে দেশের শিল্পীদের মধ্যে জেমস, গীতিকবি অভিজিৎ দাশ ও মুয়ীজ মাহফুজ; বাইরের বব ডিলান, লেনার্ড কোহেন ও টম ওয়েটস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন সানি।

ঢাকা ছাড়িয়ে কলকাতায়
প্রায় এক যুগ ধরে গাইলেও সানি পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন আরও পরে, বছর তিনেক আগে। ‘শহরের দুইটা গান’ ও ‘আমরা হয়তো’ দিয়ে সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়েছেন তিনি। সংগীতশিল্পী মৌসুমী ভৌমিক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কনসার্টে সানির গান পরিবেশনের পর থেকে কলকাতায়ও তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয়। সানির কণ্ঠে ‘আনন্দ ভৈরবী’ আপন করে নিয়েছে কলকাতা।

মৌসুমী ভৌমিক ও সানি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

সানি বলেন, ‘নিজের গান নিজে গাওয়ার মধ্যে মানুষ কীভাবে নেবে, এটা ভেবে গান করিনি। নিজের ভালো লাগার জায়গা থেকে গান করেছি।’ একাধিক গান সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পরও বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না তিনি, নিজের মতো করেই গান করে যেতে চান তিনি।
ঢাকায় ভারতীয় সংগীতশিল্পী অঞ্জন দত্তের সঙ্গে একই মঞ্চে গাইবেন সানি। ৩০ সেপ্টেম্বর আলোকি কনভেনশন সেন্টারে ‘অঞ্জন দত্ত ইন মেট্রোপলিস’ শীর্ষক কনসার্টে গাইবেন তাঁরা। কনসার্টের ঘোষণার পর কলকাতার অনেক অনুরাগী সানির গানের প্রতি ভালো লাগার কথা লিখেছেন সামাজিক মাধ্যমে।

গানের বাইরে
শূন্য দশকের গোড়ার দিকে বড় পর্দায় ওরা ১১ জন সিনেমা দেখে নির্মাণের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। নির্মাতা হতে ২০১০ সালে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর কর্মশালা করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পাট চুকিয়ে পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে ফটোগ্রাফিতে ভর্তি হন সানি। তবে বছরখানেক পর আর তা চালিয়ে যাননি।
২০১২ সালে গান শুরু করেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের দিকে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হিসেবে অভিষেক ঘটে তাঁর। এখন নিয়মিত বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করছেন সানি, ফিচার সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন রয়েছে তাঁর। ২০১৬ সালে প্রথম অ্যালবাম সানির মুক্তাঞ্চল প্রকাশ করেন। সাত বছর পর দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘লুটপাট (মিউজিক অব স্যাডনেস)’ প্রকাশ করছেন তিনি। অ্যালবামে থাকবে সাত গান, চারটি গান ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘আমরা হয়তো’ গানটি সাড়া ফেলেছে।
গানের বাইরে টুকটাক অভিনয়েও পাওয়া গেছে সানিকে। হইচইয়ের আলোচিত সিরিজ ‘কাইজার’-এ এক প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সানি। তবে অভিনয়ের চেয়ে নির্মাণেই মন দিতে চান তিনি।

আরও পড়ুন