ভূতের নেশায় দেশ চষে বেড়িয়েছেন দুই বন্ধু সুমন–শাকিব
অর্থহীনের সাইদুস সালেহীন সুমন আর ক্রিপটিক ফেইটের শাকিব চৌধুরী। বাংলাদেশের রক ও মেটাল সংগীতের দুই তারকা। আলাদা দুই ব্যান্ডের এই দুই শিল্পী দীর্ঘদিনের বন্ধু। বন্ধু দিবসে তাঁদের বন্ধুত্বের গল্প শোনাচ্ছেন নাজমুল হক
নব্বই দশকের শেষভাগ। শাকিব তাঁর ক্রিপটিক ফেইট নিয়ে মহা ব্যস্ত, সুমনও ব্যান্ড বদলে অর্থহীনে নতুনভাবে শুরু করেছেন। শাকিবের এক কাজিন সুমনের বন্ধু। তাঁর থেকে শাকিবের সব খবর পেতেন সুমন। শাকিবও সুমনের খবর রাখতেন। রক সংগীতের প্রতি দুজনের অনুরাগ, এটাই ছিল একজনের প্রতি আরেকজনের আগ্রহের মূল কারণ। তবে খোঁজখবর রাখলেও তখনো দুজনের সামনাসামনি দেখা হয়নি। সেটা হলো ১৯৯৮ সালে। মতিঝিলের বিসিআইসি মিলনায়তনের একটি কনসার্টে প্রথমবার অর্থহীনের হয়ে মঞ্চে ওঠেন সুমন। শোতে ছিলেন শাকিবও। সেই শো থেকেই শুরু হয় তাঁদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ। ২০০১ সালে জি-সিরিজের ব্যানারে ছাড়পত্র অ্যালবামে প্রকাশ পায়। এতে অন্য ব্যান্ডের সঙ্গে অর্থহীন ও ক্রিপটিক ফেইটের গানও প্রকাশ পায়। সংগীত নিয়ে দুজনের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। ২০০২ সালে ক্রিপটিক ফেইটের প্রথম বাংলা অ্যালবাম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ পায়। অ্যালবামটির ব্যবস্থা করে দেন সুমন।
আড্ডা চলে
তখন ধানমন্ডিতে থাকতেন সুমন। সাতমসজিদ রোডের সেই বাসার নিচেই ছিল স্টুডিও। সেখানে শাকিব থেকে শুরু করে আর্টসেল, নেমেসিস, ব্ল্যাক ব্যান্ডের সদস্যদের প্রতিদিনই আড্ডা হতো। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যান্ডের দামি সব রেকর্ড আনাতেন সুমন। এগুলো নিয়েই সারা দিন আড্ডা হতো। এরই মধ্যে চাকরিতে ঢুকে পড়েন শাকিব। চাইলেও আড্ডায় নিয়মিত আসতে পারতেন না। মজা করেই সুমনকে তখন শাকিব বলেছিলেন, ‘ভাই, আমার বাসা শান্তিনগর, অফিস বনানী আর আপনি থাকেন ধানমন্ডি! বাসা অফিসের দিকে নিয়ে আসেন।’ কয়েক দিনের মধ্যেই বারিধারায় চলে আসেন সুমন। এরপরই শুরু হয় দুজনের রাত-দিনের আড্ডা। সুমন মনে করেন, এ সময়েই দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। ওই সময়কে জীবনের সেরা সময় মনে করেন শাকিব।
গানের চেয়ে বেশি কিছু
সুমন-শাকিবের আড্ডায় গানের চেয়ে অন্যান্য বিষয় নিয়েই আলোচনা হয় বেশি। সিনেমা, সিরিজ, কমিক বই, গেম থেকে গেজেট—সবকিছু নিয়েই দুই বন্ধুর আড্ডা চলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত-ভোর পর্যন্ত। দুজনেই হরর সিনেমা ভালোবাসেন। একসঙ্গে দেখেছেন জনপ্রিয় সব হরর। দুজনেরই পছন্দ ‘আয়রন ম্যান’, ‘জন উইক’, ‘কনজুরিং’ ফ্র্যাঞ্চাইজি। সিরিজের মধ্যে একসঙ্গে বেশিবার দেখা হয়েছে ব্রেকিং ব্যাড ও সুপারন্যাচারাল। ২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই একসঙ্গে সিনেমা দেখেছেন দুজন। শাকিব বলেন, ‘সিনেমার বাইরে গেম নিয়ে গল্প হয়। আমি যদিও গেম পছন্দ করি না তেমন, তবে তিনি শুধু পছন্দ নয়; তাঁর বাসাই গেমের থিমে সাজানো। বালিশ থেকে তোশক, সব যেন সাইবারপাঙ্ক। এ ছাড়া নতুন কোনো গেজেট, ফটোগ্রাফি এসব নিয়ে আড্ডা দিতে সুমন ভাই পছন্দ করেন।’ বইয়ের প্রতি শাকিবের ভালোবাসা সুমনের পছন্দ। বললেন, ‘আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকি। শাকিব এগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে, তবে সে বই নিয়েই কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। এটা আমার অনেক ভালো লাগে।’
ভূতপ্রেম
হরর সিনেমা দেখার পাশাপাশি দুই বন্ধুর রয়েছে ভূতপ্রেম। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন। পুরোনো বাড়ি, শ্মশানঘাট, বটগাছতলা—যেসব জায়গা নিয়ে নানা ধরনের ভৌতিক গল্প চালু আছে, সেসব জায়গায় চষে বেড়িয়েছেন। ভূতের উপস্থিতি ধরতে বিদেশ থেকে বিভিন্ন জিনিস আনাতেন সুমন। শাকিবের এসবে কিছুটা ভয় থাকলেও খুব মজা পেতেন সুমন। এ সময় দুজনের কাছে জমা হয় ভূতের অনেক গল্প। এ থেকেই একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন সুমন, শাকিব ও তাঁদের আরেক বন্ধু জিবরান। তিনজন মিলে শুরু করেন রেডিও শো ‘ভৌতিস্ট’। শাকিব জানান, সায়েন্টিস্ট থেকে ভৌতিস্ট। নিজেদের তাঁরা তখন ভূতবিশারদ ভাবতে শুরু করেন। টানা দেড় বছর চলে এই শো। মূলত এই অনুষ্ঠান থেকেই শুরু হয় ভূত নিয়ে রেডিও শোর জনপ্রিয়তা।
খাবারপ্রীতি
সুমন-শাকিবের আড্ডার বড় একটা অংশজুড়ে থাকে খাবার। এটা যেমন শুরুতে ছিল, এখনো আছে। গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় দিনের পর দিন জমত তাঁদের আড্ডা। শাকিব বলেন, ‘তখন তো সব খাবার কেনার পয়সা ছিল না। সুমন ভাই সব খাওয়াতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে এত ভালোবাসেন! সন্ধ্যা থেকে এ আড্ডায় অনেক খাওয়া হতো। মাঝরাতে আড্ডা শেষ হলেই রেস্তোরাঁ বন্ধ হতো, এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল।’ তবে সুমনের কাছে বন্ধুর সঙ্গে খাবারের স্মৃতিতে আছে রাস্তার পাশের সস্তা হোটেল। দেশের আনাচকানাচে হোটেল খোঁজে বেড়াতেন তাঁরা। সুমন বলেন, ‘পেটখারাপের চিন্তা না করে কবজি ডুবিয়ে খেতাম। ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে টার্মিনালের হোটেল ছিল পছন্দের তালিকায়। ভর্তা-ভাত হলে আমাদের আর কিছুই লাগত না।’
বন্ধুকে নিয়ে না–বলা কথা
সুমনের কাছে শাকিব সত্যবাদী ও সোজাসাপ্টা একজন মানুষ। এ জন্যই বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে। সুমন বলেন, ‘তেলবাজি ও মিথ্যা সবচেয়ে অপছন্দ করি। এসব শাকিবের মধ্যে নেই বলেই ওকে ভালো লাগে।’ শাকিবের কাছে সুমন একজন কিংবদন্তি। মানুষ হিসেবে পরোপকারী। শাকিবের কথায়, ‘কেউ মারা গেলে তাঁকে নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। সুমন ভাইয়ের জীবদ্দশায় বলছি, উনি এত কিছু করেছেন, করেন আমার জন্য, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও তা শোধ হবে না।’