গানের সুরে, মেজবানের ঘ্রাণে—সিডনি যেন এক দিনের চট্টগ্রাম

নকীব খান শুনিয়েছেন তার জনপ্রিয় বেশ কিছু গানপ্রথম আলো

একদিকে মেজবানের ঘ্রাণে মাতোয়ারা পরিবেশ, অন্যদিকে মঞ্চে নকীব খানের কণ্ঠে সুরের ঝংকার-দুয়ের মেলবন্ধনে গত রোববার সিডনির ফেয়ারফিল্ড শোগ্রাউন্ড যেন পরিণত হয়েছিল এক টুকরা বাংলাদেশে। ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতি অস্ট্রেলিয়া’ আয়োজিত ‘চট্টগ্রাম উৎসব–২০২৫’ ছিল প্রবাসী বাঙালিদের এক দিনের আনন্দমেলা, যেখানে একদিকে মেজবানি মাংসের স্বাদে ভরে উঠেছে পেট আর অন্যদিকে নকীব খানের কালজয়ী গানে ভরে গেছে মন।

চট্টগ্রামের ঘ্রাণে সিডনি
৩০ বছরের রান্নার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাবুর্চি আবুল হোসেনকে বিশেষভাবে বাংলাদেশ থেকে আনা হয় এই উৎসবের মূল আকর্ষণ হিসেবে। দুপুর থেকেই ফেয়ারফিল্ড শোগ্রাউন্ডে শুরু হয় অতিথিদের ভিড়। প্রায় তিন হাজার মানুষের জন্য সাজানো হয়েছিল পাঁচটি পরিবেশন কর্নার, টেবিল আর সুশৃঙ্খল বসার ব্যবস্থা। কেউ বলছিলেন, ‘এ যেন বাংলাদেশের কোনো শিল্পপতির বাড়ির জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান।’ প্রবাসীদের একাধিকবার লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে দেখা যায়। কেউ কেউ বলছিলেন, ‘সিডনিতে বসে আবুল বাবুর্চির মেজবানি খেতে পারব, ভাবতেই পারিনি। মনে হচ্ছিল, চট্টগ্রামের কোনো পাড়ার উৎসবে বসে আছি।’

সুরে সুরে নকীব খান
খাবারের পর শুরু হয় মঞ্চে সুরের আসর। সন্ধ্যা নামতেই আলো-রঙে মুখর মঞ্চে ওঠেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নকীব খান—রেনেসাঁ ব্যান্ডের প্রাণপুরুষ। ৬০ পেরিয়েও তাঁর কন্ঠে যেন সেই পুরোনো দীপ্তি ও সেই পরিচিত আবেগ। গানের শুরুতেই দর্শকেরা উঠে দাঁড়ালেন, কেউ মুঠোফোন হাতে ভিডিও করছেন, কেউবা মুগ্ধ হয়ে গলা মিলাচ্ছেন তাঁর সঙ্গে।
নকীব খান একে একে গেয়ে শোনান ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘আর দেশে যাইও তুই’, ‘ভালো লাগে না’, ‘এমনই একটা দিন’—প্রতিটি গানেই দর্শকেরা কণ্ঠ মিলিয়েছেন। মঞ্চে ছিলেন স্থানীয় শিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী তরুণী আদিলা নূর গেয়ে শোনান সুপরিচিত গান।
মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় গীতিকার আবদুল্লাহ আল মামুন, যিনি ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ ও ‘মুখরিত জীবন’—এর মতো বিখ্যাত গানের গীতিকার। তিনি এক পর্যায়ে মঞ্চে উঠে গলায় ধরেন নিজের লেখা গান, নকীব খানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান তিনিও।

গীতিকার আবদুল্লাহ আল মামুন ও নকীব খান মঞ্চে
প্রথম আলো

উৎসবের আবেগ ও আয়োজক কথা
আয়োজক ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতি অস্ট্রেলিয়া’র সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসে থেকেও আমরা চেয়েছি নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সংগীতের ঐতিহ্য তুলে ধরতে। অনেকে দেশে গেলেও এখন আর সহজে আসল মেজবানি খাওয়ার সুযোগ পান না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চট্টগ্রামের স্বাদ আর গানের আবেশ একসঙ্গে নিয়ে আসব সিডনিতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই আয়োজনে স্থানীয় সরকার ও পৃষ্ঠপোষকেরা আমাদের পাশে ছিলেন। এক মাস ধরে প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত প্রস্তুতি চলেছে। প্রায় লক্ষাধিক ডলারের এই আয়োজনের সাফল্য আমাদের সব পরিশ্রম সার্থক করেছে।’

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেজবানকে সিডনির মাটিতে এনে যিনি সবার মন জয় করলেন, সেই বাবুর্চি আবুল হোসেন নিজেও ছিলেন আবেগাপ্লুত। তিনি বলেন, ‘সিডনির মানুষের এই ভালোবাসা আমি কোনো দিন ভুলব না। মনে হচ্ছিল, আমি চট্টগ্রামেই আছি। সুযোগ পেলে আবারও এখানে রান্না করতে চাই।’

দুপুর থেকেই ফেয়ারফিল্ড শোগ্রাউন্ডে শুরু হয় অতিথিদের ভিড়
প্রথম আলো

সিডনির বুকে বাংলাদেশের উৎসব
রোববার সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এই উৎসবে তিন হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি অংশ নেন। কেউ এলেন পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে। কারও হাতে দেশের পতাকা, কারও গলায় ছিল গামছা। চট্টগ্রামের উপভাষা, গানের তালে তালে নাচ—সব মিলিয়ে সিডনি যেন এক বিকেল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম। সন্ধ্যার শেষ পর্বে নকীব খান যখন গাইলেন ‘আর দেশে যাইও তুই’, তখন কেউ কেউ চোখ মুছছিলেন। প্রবাসের মাটিতে দেশের সুরে সেই মুহূর্তটা হয়ে উঠেছিল গভীর, আবেগঘন ও চিরস্মরণীয়।