২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়...সুপারহিট সেই গানের গল্প

সুপারহিট সেই অ্যালবামের গল্প শোনালেন অবসকিউরের টিপু

‘মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়’, ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’, ‘ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী’, ‘কলিকালের ভণ্ড বাবা’ কিংবা ‘বিধি তোমার কেমন খেলা’ গানগুলো শোনেননি বা গুনগুন করে গাননি এমন ব্যান্ড সংগীতানুরাগী কম আছেন। বিশেষ করে আশির দশকের শেষ দিকে কিংবা নব্বইয়ের শুরুতে গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন এমন শ্রোতারা। এখন যাঁরা ব্যান্ড সংগীত ভালোবাসেন, বয়স যাঁদের চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে, এমন শ্রোতার কাছে অবসকিউরের আলাদা কদর আছে। অবসকিউর এমন গানের দল, যাদের শুরুটা ছিল ‘এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম’-এর মতো। প্রথম অ্যালবামেই যাঁরা বাজিমাত করেছিলেন। যে অ্যালবামের গানগুলো আজও ইউটিউবে খুঁজছেন শ্রোতারা, আজও লাইভ অনুষ্ঠানে অনুরোধ আসে, ‘মাঝরাতে চাঁদ’ গানটা শুনতে চাই...।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সে সময় খুলনার তরুণ শিল্পী সাইদ হাসান টিপু এই ব্যান্ড গড়ার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ খুলনায় অবসকিউর প্রতিষ্ঠা করেন টিপু। সে সময় সারগাম স্টুডিওতে শুরু হয় দলটির প্রথম অ্যালবামের কাজ। ১৯৮৬ সালে সেলফ টাইটেল ‘অবসকিউর ভলিউম ১’ শিরোনামে বের হয় ব্যান্ডের অ্যালবাম। অবসকিউরের অন্যতম উদ্যোক্তা শিল্পী টিপু এক সাক্ষাৎকারে অবসকিউরের প্রথম অ্যালবামের গল্প শুনিয়েছিলেন।

সে সময় ব্যান্ডের লাইনআপ ছিলেন ভোকাল টিপু, বেজ গিটার মাসুদ, লিড গিটার জন, রিদম গিটার তুষার, ড্রামস আজম বাবু ও কি-বোর্ড সোহেল। এই শিল্পীরা মিলে শুরু করেছিলেন প্রথম অ্যালবামের কাজ। মোট ১২টি গানের আলোচিত ‘মাঝরাতে চাঁদ যদি’ লিখেছিলেন টিপুর বড় বোনের বান্ধবীর ভাই এহসান। অন্য গানগুলো লিখেছিলেন সোহেল আলম চৌধুরী ও টিপু।

পুরোনো দিনের অবসকিউর। ছবি: সংগৃহীত

স্মৃতিচারণা করে টিপু জানান, বাবার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়ে ব্যান্ডের অ্যালবাম করার জন্য ঢাকা এসেছিলেন তাঁরা। অবশ্য আসার সময়েও কম ঝামেলা হয়নি। টিপু বলেন, ‘কি-বোর্ডিস্ট সোহেলের বাবার দুই চোখের বিষ হয়ে গেলাম আমি। তাঁর ছেলে এসব ছন্নছাড়া টাইপের গানবাজনা করবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। সেসবের জন্য আবার ঢাকায় যেতে হবে! শেষে ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে তিনি হুমকি দিয়ে বসলেন, ছেলে যদি ঢাকায় যায়, তাহলে তাঁর মাকে তিনি ডিভোর্স দেবেন। বিরাট ঝামেলা লেগে গেল তাঁর বাসায়।’
মা বোঝেন, বাবা বোঝেন না। আমরা কয়েকজন মিলে বহু কষ্টে তাঁকে রাজি করালাম। সোহেলের পুরো দায়িত্ব নিলাম। ঢাকায় এসে বাদল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। সত্যি কথা বলতে, কিছু মানুষ আশীর্বাদ হয়ে আমাদের জীবনে এলেন।

ফুয়াদ নাসের বাবু ভাই, মাকসুদ ভাই, লাবু ভাই, পিয়ারু ভাই, শেখ ইশতিয়াক ভাই, মাকসুদ জামিল মিন্টু ভাইসহ আরও অনেকের নাম বলতে হয়।’ টিপু বলেন, ‘আমাদের কি-বোর্ডিস্ট সারা জীবনে হারমোনিয়াম ছাড়া কিছু চোখে দেখেনি। তাকে দেওয়া হলো মানাম আহমেদের বাবার কাছ থেকে ভাড়া করা ইয়ামাহা ডিএক্স ৭ কি-বোর্ড। সেটার কিছুই সে জানে না। এগিয়ে এলেন বাবু ভাই, মিন্টু ভাই। কোন গানে কী টোন দিয়ে বাজালে ভালো লাগবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিলেন।’

‘মাঝ রাতে চাঁদ যদি’ গানটি লিখেছিলেন এহসান। ছবি: সংগৃহীত

টিপুর ভাষায়, সংগীতচর্চার জন্য ওই সময়টা ছিল দারুণ অনুকূল। সে সময়টায় গানের মানুষেরা যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন, তা অবিশ্বাস্য। পুরো ফিডব্যাকের সঙ্গে আমাদের আজব এক বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল সে সময়। ঠিক হলো রাত ১১টার পর তিন দিন ধরে অবসকিউরের গানের কাজ হবে। কেননা দিনের বেলায় অন্যদের কাজ হয়। যাঁরা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের কাজই প্রাধান্য পাবে। ঠিক হলো প্রথম দুদিন ট্র্যাকিং হবে আর শেষ রাতে ভোকাল। টিপু জানালেন, সে সময় তাঁদের কারোরই রেকর্ডিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছিল। ঢাকার স্টুডিওতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারে নতুন অভিজ্ঞতা হলো অবসকিউর দলটির। সেই অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিয়ে টিপু বলেন, ‘পিয়ারু ভাই কয়েকটা চারকোনা বস্তু দিয়ে গেলেন, সেগুলোতে স্টিক দিয়ে বাড়ি মারলে অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ হয়। একটা ছিল ঝিরিঝিরি আওয়াজের। পরে জেনেছিলাম এটাকে চাইম বেল বলে।

অ্যালবামের শেষ গান “তোমায়”-এ যে যখন পেরেছে, একটা করে চাইম বেলের বাড়ি দিয়ে এসেছে। একটা ছিল ডুডুং আওয়াজ করত, যেটা আসলে ’৮০-এর ডিসকো গানগুলোতে অনেক ব্যবহৃত হতো। তো আমরা এই ডুডুং টাইপের টমগুলো বেশ কিছু গানে পিটিয়ে দিলাম। বিশেষ করে ‘মনে পড়ে’, ‘মাঝরাতে চাঁদ’ গানগুলোতে। গোল বাধল জনের গিটারেও। কিছুতেই সেটা ঠিকমতো বাজে না, বারবার ভুল হয়। প্রচুর গালি খেতে খেতে একপর্যায়ে সে বলে বসল, আমি বাজাব না। আমি তখন হতাশার চরম পর্যায়ে। বললাম, তুই বাজাবি, তোর বাপ বাজাবে। ফাজলামি করতে এসেছি এখানে?’

এখনো অবসকিউরের হাল ধরে আছেন সাইদ হাসান টিপু। ছবি: ফেসবুক থেকে

শেষ রাতে ছিল কণ্ঠ দেওয়ার পালা। সেদিন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন টিপু। সকাল থেকে ডায়রিয়া।

‘ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছিল না। একটু পরপর দৌড়ে বাথরুমে যাচ্ছি। সারগামের বাথরুম দোতলায়, স্টুডিও থেকে বের হয়ে লম্বা একটা প্যাসেজ পার হয়ে ওপরে উঠতে হতো। আমি একটু করে গাই, চাপ এলেই দৌড় দিই। এর মধ্যেই ১২টা গান রাতভর গেয়ে শেষ করলাম। গাইতে এত কষ্ট আমার জীবনে হয়নি। বাথরুমে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত শেষ হলো ১২টি গানের কণ্ঠ ধারণ।’

নব্বই দশকে মঞ্চে পরিবেশন করছে অবসকিউর

সারা রাতে রেকর্ডিং শেষ। পরদিন ভোরবেলা বের হলো সবাই। একটু জিরিয়ে নেওয়া। সকালে সারগামের শিফট খালি। সেই সুযোগে গানগুলোর হারমনি দিতে ঢুকেছেন টিপু। হঠাৎ দেখলেন সে সময়ের সুপরিচিত শিল্পী তপন চৌধুরী আর লাকী আখান্দ্‌ কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়লেন। সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণা করে টিপু বলেন, ‘আমার গলা থেকে কে যেন আওয়াজ কেড়ে নিল। এরা আমার স্বপ্নের মানুষ, এদের সামনে গাই কীভাবে! দুজনেই আমাকে সাহস দিলেন, পিঠ চাপড়ে দিলেন। শেষ হলো রেকর্ডিং অধ্যায়, সারগাম স্টুডিওতে আমাদের প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম।’

রেকর্ডিং শেষ করে অবসকিউরের সবাই ফিরে গেলেন খুলনায়। অপেক্ষা, কবে অ্যালবাম বেরোবে। খুলনা থেকে বারবার পান্না আজম ও বাদল ফোন করে খবর নিতে থাকেন। একদিন ঠিক প্রকাশ পেল অ্যালবামটি। খরচ ১২ হাজার টাকা! সারগাম সেই ১২ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছিল। টিপুর ভাষায়, ‘অবসকিউরের ইতিহাস তৈরি করা অ্যালবাম ১২ হাজার টাকার, কিন্তু আমাদের কাছে সেই অভিজ্ঞতা ও ভালোবাসা অমূল্য।’

(লেখাটি ২০২০ সালের ২ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশ হয়েছিল)