বিজ্ঞাপনে, জেমসের গানে ‘সুন্দরীতমা’: কল্পনা, প্রেম নাকি বাস্তব

বিজ্ঞাপনে, গানে ‘সুন্দরীতমা’ এসেছে বারবারকোলাজ

ভক্তদের কাছে তিনি ‘গুরু’। গানের জগতে পদার্পণ করেছিলেন আশির দশকে। তারপর ক্রমে ক্রমে সময়ের শিলালিপিতে লিখেছেন নিজের নাম। জয় করে নিয়েছেন শ্রোতার হৃদয়। দীর্ঘদিন কোনো অ্যালবাম প্রকাশের খবর যেমন শোনা যায়নি, সেই অর্থে তেমন সাড়া জাগানো কোনো গানও আসেনি। তারপরও শ্রোতাপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি। বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী জেমসের কথা বলছি।

ফারুক মাহফুজ আনাম থেকে জেমস হয়ে ওঠার গল্প কমবেশি সবারই জানা। প্রজন্মের পর প্রজন্মে ধ্বনিত হচ্ছেন তিনি, ধ্বনিত হচ্ছে তাঁর গান। তাঁর গানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—সবাই তাঁর গানকে আপন করে নিতে পারেন। গানের ক্ষেত্রে সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। জেমসের অনন্যতা এখানেই। তাঁর গান সবাইকে পরশ দিয়ে যায়। তাই তো একসঙ্গে গলা মিলিয়ে তরুণেরা গেয়ে ওঠেন, ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার’।

১৯৯৬ সালের ‘নগরবাউল’ অ্যালবামের গান ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’। গানটি নিয়ে জেমসের শ্রোতাদের আহ্লাদের শেষ নেই।

কোথায় পৌঁছায়নি এই গান। পাড়া–মহল্লা, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসার্ট হলে গানটা বেজে ওঠা রীতির মতো হয়ে গেছে। তা ছাড়া প্রথম প্রেমে পড়ে কিংবা দূর থেকে ভালোবেসে কিংবা কাউকে ভালো লাগলে অনেকে যেমন গেয়ে ওঠেন, ‘সুন্দরীতমা আমার…আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার’। তেমনই কেউ কেউ জিজ্ঞাসুদৃষ্টে প্রশ্ন করেন, গানের এই ‘সুন্দরীতমা’ আসলে কে?

জেমস
খালেদ সরকার

গল্প, উপন্যাস, কবিতার মতো বাংলা গানেও নানা সময়ে নানা চরিত্র এসেছে। কিছু চরিত্র জনপ্রিয়ও হয়েছে। ‘রুবি রায়’, ‘বেলা বোস’, ‘মালা’, ‘রঞ্জনা’ প্রভৃতি। ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’ গানে যে ‘সুন্দরীতমা’র কথা আছে, এটিও কি এমনই কোনো চরিত্র? বলব, তার আগে সুন্দরীতমার আরও কিছু দৃষ্টান্ত দেখে নেওয়া যাক।

বিজ্ঞাপনে ‘সুন্দরীতমা’

‘তুমি হাঁটলে ঢেউ ওঠে পথে
না হাঁটলে ওঠে ঝড়
তুমি তাকালে আমি আর আমি নাই
না তাকালে সব গড়বড়
তুমি বসলেই আমি একা থেমে যায়
না বসলে থামে সব
তুমি হাসলে যেন একফালি চাঁদ
না হাসলে পূর্ণিমা
সুন্দরীতমা….’

ক্রমে ক্রমে গানের কথাগুলো বেজে চলেছে। কখনো সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আবার কখনো ঘরে দাঁড়িয়ে একজন তরুণী কখনো হাসছেন, কখনো গম্ভীর মুখ করছেন, কখনো দোলনায় দোল খাচ্ছেন, কখনো ফুটবলে পা, কখনো হাসিমুখে হাততালি দিচ্ছেন, কখনো সমুদ্রের জলে পা ভেজাচ্ছেন। একেবারে শেষে তরুণী যখন আয়নায় মুখ দেখেন, তখনই একজন তরুণের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘ সুন্দরীতমা, আমি জানি তোমার রূপের রহস্য কী?’

সাবানের বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেন জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সুন্দরীতমা চরিত্রটিকে বিজ্ঞাপনে ফুটিয়ে তোলেন শ্রাবস্তী দত্ত তিন্নী। জিঙ্গেলটিতে কণ্ঠ দেন এস আই টুটুল। প্রায় ২০ বছর আগের বিজ্ঞাপনটির কথা দর্শক আজও মনে রেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ক্লিপটি শেয়ার করে অনেককেই স্মৃতিচারণা করতে দেখা যায়।

শ্রাবস্তী দত্ত তিন্নি
ফাইল ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘সুন্দরীতমা’

শামসুর রাহমান বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাশালী কবিদের একজন। তাঁর কবিতায় যেমন এসেছে রাজনীতি, তেমনি শব্দে–অক্ষরে আলোকিত হয়েছে নাগরিক জীবনের নানা রূপ, রং, যন্ত্রণা; প্রেম ও ভালোবাসা। তাঁর কবিতা থেকে গানও হয়েছে। কবি নিজেও তরুণ বয়সে গান লিখেছেন। রেডিও–টেলিভিশনের পাশাপাশি সিনেমায়ও শোনা গেছে তাঁর লেখা গান। দেশপ্রেম, গ্রামবাংলার ছবি, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, দেশের প্রতি মমত্ববোধ প্রবলভাবে তাঁর গানে মূর্ত হয়েছে।

শামসুর রাহমানের লেখা ‘স্মৃতি ঝলমল সবুজ মাঠের কাছে, আমার অনেক ঋণ আছে’ শিরোনামের দেশাত্মবোধক গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা। গানটির সুর করেন খন্দকার নুরুল আলম। এ ছাড়া ‘এ দেশ আমার’, ‘মধুময় পৃথিবীকে নীল আকাশ ডাকবেই, সাগরের পরিচয় ফের মনে রাখবেই’সহ বেশ কিছু গান রয়েছে তাঁর। যার কিছু কবিতা হিসেবেও পাঠকমহলে পরিচিত।

শামসুর রাহমানের লেখা গান চলচ্চিত্রে প্রথম শোনা যায় ১৯৫৯ সালে। চলচ্চিত্রটির নাম ‘ মাটির পাহাড়’। সিনেমাটির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন সৈয়দ শামসুল হক। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সমর দাশ।

যাহোক একসময় সব ভুলে হৃদয়ের সব সৌন্দর্য কবিতায় সমর্পণ করে শামসুর রাহমান আপন করে নেন ‘কবি পরিচয়কে’। কিন্তু তারপরও গানের ইতিবিবরণী শেষ হয়ে যায়নি তাঁর। পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতা থেকে হয়েছে গান। সত্তরের দশকে তাঁর ‘কখনো আমার মাকে’ শিরোনামের কবিতাটিকে গানে রূপ দেওয়া হয়। গানটির সুর করেন সত্য সাহা, কণ্ঠ দেন রফিকুল আলম। এ ছাড়া ২০২৪ সালে এ কবিতা থেকেই কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর উপন্যাসের নামকরণ করেন, ‘কখনো আমার মাকে’।

সত্তরের দশকের পর ১৯৯৫ সালে আবাওে গানে কবি শামসুর রাহমানের প্রত্যাবর্তন ঘটে। সরাসরি নয়, একটু ভিন্নভাবে। তাঁর ‘উত্তর’ কবিতাটি থেকে গান করার জন্য অনুমতি চান জেমস। তত দিনে নব্বইয়ের দশকের তরুণেরা জেমসকে চিনে গেছেন। তাঁর গানের নতুনত্ব আকর্ষণ করেছে শ্রোতাদের। শামসুর রাহমান অনুমতি দেন। ‘উত্তর’ কবিতা থেকেই জেমস ‘নগরবাউল’ অ্যালবামের ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’ গানটি তৈরি করেন। এর পরের ঘটনা সবারই জানা। গানটা পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।

‘সুন্দরীতমা’র রহস্য

‘সুন্দরীতমা’ প্রথম পাওয়া যায় শামসুর রাহমানের ‘উত্তর’ কবিতায়। কবি যেমনটা বলেছেন, ‘নীল আকাশ’, ‘ক্যামেলিয়া’, ‘জ্যোৎস্না’ যাকেই ‘তুমি’ বলো না কেন ‘তুমি আমার’ সবাই থাকবে ‘নিরুত্তর’। ‘মানুষ আমি’ আমাকে ‘যদি বলো’ ‘তুমি একান্ত আমার’ তখন আমি কি ‘নির্বাক থাকতে পারব?’ আমি তো ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’ যে ‘তুমি আমার’।

বৃষ্টিমুখর দিনে জানালায় হাত দেখে ‘একখানা হাত’ শিরোনামে কবিতা লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘উত্তর’ কবিতার ‘সুন্দরীতমা’ সৃষ্টির পেছনে তেমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি না; সুন্দরীতমা আদৌ কি রক্তমাংসের মানুষ? নাকি কাউকে দেখে অভিভূত হয়ে কবিতা নির্মাণের নিয়মেই শামসুর রাহমান সুন্দরীতমা শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।

আর ‘উত্তর’ কবিতা থেকেই জেমস যেহেতু গানটি তৈরি করেন, তাই এ ক্ষেত্রেও তেমন কোনো জোরালো যুক্তি না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সুন্দরীতমা মানুষই হোক আর উপমাই হোক, কিংবা হোক প্রিয় সম্বোধন, ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’ গানের বাণী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে ধ্বনিত হবে, তরুণদের হৃদয় জিতে নেবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আজ থেকে বহু বছর পরেও কাউকে ভালো লাগলে, কিংবা প্রিয় মানবীকে দেখে নিশ্চয়ই কেউ গুনগুন করে কিংবা চিৎকার করেই গেয়ে উঠবেন, ‘সুন্দরীতমা আমার…আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার।’