তাহসানের চার অধ্যায়

তাহসান

দুই দশক পার করল তাহসান রহমান খানের গানের ক্যারিয়ার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ব্যান্ড ও একক মিলিয়ে ১১টি অ্যালবাম করেছেন। নাটক ও চলচ্চিত্র মিলিয়ে প্রকাশিত গানের সংখ্যা প্রায় ২০০। গানের পাশাপাশি তাঁকে অভিনয়েও দেখা গেছে; করেছেন টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র।

২০ পার করে ২১-এ যখন গানের বয়স, তাহসান ফিরে গেলেন ২০ বছর আগে—২০০২ সালে ব্ল্যাক–এর অ্যালবাম ‘আমার পৃথিবী’তে তাঁর গান ‘এখনো’ তখন সুপারহিট। তাহসান বলেন, ‘একদিন এলিফ্যান্ট রোড হয়ে ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছিলাম। ওই পথে তখন অনেক ক্যাসেট ও সিডির দোকান। সব জায়গায় বাজছে “এখনো”। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। কেউ চেনেন না, অথচ সবাই আমার গান শুনছেন।’ এখন মঞ্চে ‘এখনো’ গাইতে শুরু করলে দর্শক মুখ থেকে কেড়ে নিয়েই গাইতে থাকেন। এ নিয়ে ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাহসান বলেন, ‘এত বছর পরও আমার গান শুনছেন, এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর কী হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের জীবনে প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি থাকে। গানে আমার প্রাপ্তিই বেশি। এত দীর্ঘ সময় ধরে যাঁরা আমার গান শুনে চলেছেন, শ্রোতাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।’ ক্যারিয়ারের দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে আলো ফেলা যাক তাহসানের জীবনের চারটি অধ্যায়ে।

প্রথম একক অ্যালবাম ‘কথোপকথন’-এ তাহসান

প্রথম অধ্যায়: রক থেকে পপ
১৯৯৮ সালের দিকে বন্ধুদের নিয়ে অলটারনেটিভ রক ব্যান্ড দিয়ে তাহসানের শুরুটা হয়েছিল। শুরুতে গানটা নিজেদের ভালো লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যান্ড হিসেবে শো করতেন। গানগুলো ছিল রক ঘরানার। শুরুর দিকে তাহসান কি-বোর্ড বাজাতেন, অল্প কিছু গান করতেন। সে সময় তাহসানের নিজের লেখা কিছু গান করা ছিল। যেগুলো রক নয়, পপ। তাহসান বলেন, গানগুলো শুনে ব্যান্ডের সবাই বলল, ‘তোর পপ গানগুলো কর।’ ২০০৪ সালে ‘কথোপকথন’-এ গানগুলো বের হওয়ার পর শ্রোতারা ভালোভাবেই নিলেন। তখন থেকেই ব্যান্ডের গানের ধাঁচেও বদল এল। তাহসানের মতে, এখান থেকেই তাঁর গানের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু।

এখন গান নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান তাহসান খান

দ্বিতীয় অধ্যায়: পপ দুনিয়া
কথোপকথন-এর ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ ও ‘ঈর্ষা’ গানগুলো ছড়িয়ে পড়ল। তাহসান বলেন, ‘প্রথম অ্যালবামের গানগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের শ্রোতাদের মধ্যেই বেশি আলোচিত ছিল। কিন্তু এ গান দুটি দেশের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে যেতে শুরু করল। যেখানেই শো করতে যাই, গানগুলো গাওয়ার দাবি উঠতে থাকে।’ পরের তিনটা বছর তাহসানের কাছে রূপকথার মতো। সেটা কেমন, তাঁর মুখেই শোনা যাক, ‘প্রতিবছর একটা করে অ্যালবাম মুক্তি দিতাম, ওই বছর সবচেয়ে আলোচিত গান হিসেবে আমার গান থাকত।’

২০০৮ সালে চলে গেলাম। যাওয়ার আগে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বলেছিলেন, “গান বাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন, এটা একরকম আত্মহত্যা। আপনাকে কেউ মনে রাখবে না।” আমি বলেছিলাম, আমার গান ভালোবাসেন শ্রোতারা। গান তো আর হারিয়ে যাবে না। গান বেঁচে থাকলে আমিও শ্রোতাদের কাছে বেঁচে থাকব।

২০০৫ সাল মুক্তি পাওয়া ‘কৃত্যদাসের নির্বাণ’ অ্যালবামের ‘প্রেমাতাল’ গানটিও জনপ্রিয় হলো। পরের বছর ইচ্ছে অ্যালবামের ‘আলো’ সে সাফল্যকেও ছাড়িয়ে গেল। ‘অ্যালবাম প্রকাশের পরপর “আলো” শ্রোতারা এমনভাবে নিয়েছিলেন, মনে হলো বাংলাদেশে কী যেন হয়ে গেল। আমি যেন গানের রূপকথার নায়ক। ভক্ত-শ্রোতার ভালোবাসা কী অসাধারণ হতে পারে, সেটা তখনই টের পেলাম। খ্যাতির বিড়ম্বনাও টের পেয়েছি। হাবিব ওয়াহিদ তো মজা করে বলতেন, “বাংলাদেশে মনে হয় আমরা দুজনই সংগীতশিল্পী আছি,”’ বলেন তাহসান।

আরও পড়ুন

তবে এরপর এল পাইরেসি, যা বদলে দিল গান প্রকাশের গতিপথ। সিডি বিক্রি বন্ধ হতে থাকে, গান করা কমিয়ে দিলেন তাহসান। তাঁর ইচ্ছে অ্যালবামটিই শেষ সিডিতে বিক্রি হয়েছে। এরপর বৃত্তি নিয়ে এমবিএ করতে দেশের বাইরে চলে গেলেন।

তাহসান বলেন, ‘২০০৮ সালে চলে গেলাম। যাওয়ার আগে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বলেছিলেন, “গান বাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন, এটা একরকম আত্মহত্যা। আপনাকে কেউ মনে রাখবে না।” আমি বলেছিলাম, আমার গান ভালোবাসেন শ্রোতারা। গান তো আর হারিয়ে যাবে না। গান বেঁচে থাকলে আমিও শ্রোতাদের কাছে বেঁচে থাকব। ওই সময় পাইরেসির কারণে গান নিয়ে এগোনো কঠিন ছিল। কারণ, তত দিনে সিডি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বাইরে থাকার সময় গান, অ্যালবাম—কোনোকিছুই করিনি।’

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তাহসান

তৃতীয় অধ্যায়: দেশে ফেরা
২০১১ সালে দেশে ফেরেন তাহসান। এসেই গান শুরু করলেন। পাশাপাশি পা রাখলেন নতুন আঙিনায়—অভিনয়। আগে নিজের গান বেশির ভাগই লিখতেন, সুর করতেন। দেশে ফিরে অন্যের লেখা আর সুরে গান গাওয়া শুরু করলেন তিনি। ‘ওই সময় পরিচালক শিহাব শাহিন আমাকে দিয়ে পরপর তিনটি নাটকে অভিনয় করালেন। সাজিদ সরকারের সুরে নাটকের গানগুলোও আমি করলাম। শ্রোতারাও পছন্দ করলেন। আমার ক্যারিয়ারে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো,’ বলেন তাহসান।

মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় তো আছেই। ছোট পরিসরে ওর দুটি গানে আমি অতিথি শিল্পী ছিলাম। বড় পরিসরে একটা অ্যালবাম করব। সেখানে ও আমার সঙ্গে কণ্ঠ দেবে। এতটুকুই। এর বাইরে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ অনেক কিছুই বলবে, আমার কিছু বলার নেই

গানের পাশাপাশি অভিনয়ও চলতে থাকল। সিনেমায়ও গাইলেন, ২০১৫ সালে ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবিতে তাঁর গান জনপ্রিয়তা পায়। তবে নাটকে গান করতে এসে ভক্ত-শ্রোতাদের ভেতর কিছুটা বিভক্তি লক্ষ করেছেন তাহসান, ‘সবার রুচি তো এক হবে না। সবারই বিভিন্ন ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে। শিল্পীদের টিকে থাকতে নিজের পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সব শ্রেণির শ্রোতাদের জন্য নানা গান করতে হবে। ভক্ত-শ্রোতাদের মধ্যে তো বিভেদ করা যাবে না। একটি গান একজনের পছন্দ হবে, আরেকটি অন্যজনের।’

তাহসান

চতুর্থ অধ্যায়: নতুন শুরু
সংগীতে দুই দশক পার করে নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে যাচ্ছেন তাহসান। ঠিক করেছেন, দেশের বাইরে গিয়ে সংগীতের ওপর লেখাপড়া করবেন। তাহসান বলেন, ‘ছোটবেলায় ছায়ানটে গান শিখেছি। সেই শিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে এত দিন কাজ করে আসছি। এখনো দু-তিনটি জায়গায় কাজ করা হয়নি। সেটি করতে চাই। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এক বছর পড়ালেখা করব। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন কাজ শ্রোতাদের দিতে চাই।’ অনেক কাছের মানুষ তাহসানের কাছে জানতে চান, আগে ইনস্ট্রুমেন্টাল, রবীন্দ্রসংগীত, ইংরেজি গান করলেও এখন কেন করেন না?

‘যদি একদিন’ ছবিতে অভিনয় করেছেন তাহসান ও শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
প্রেমের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় তো আছেই। ছোট পরিসরে ওর দুটি গানে আমি অতিথি শিল্পী ছিলাম। বড় পরিসরে একটা অ্যালবাম করব। সেখানে ও আমার সঙ্গে কণ্ঠ দেবে। এতটুকুই। এর বাইরে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানিয়ে তাহসান বলেন, ‘এখন যেভাবে কাজ করি তা তো করবই, পাশাপাশি নিজেকে অন্যভাবে দেখতে চাই। মিউজিক স্কুল শেষ করে একটি ইংরেজি, একটি ইনস্ট্রুমেন্টাল অ্যালবাম করব। অন্য ভাষায়ও গান করব। রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করারও ইচ্ছা আছে। নতুন অধ্যায়ে বিদেশের বন্ধুদের সঙ্গেও দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়ার চেষ্টা থাকবে।’

‘হঠাৎ বিয়ে’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম ও তাহসান। ছবি: ফেসবুক থেকে

‘বিদেশি বন্ধু’র কথা উঠতেই তাহসানের কাছে প্রেম-বিয়ে প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলো। গুঞ্জন আছে, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক গায়িকার সঙ্গে নাকি তাঁর প্রেম চলছে। তাহসান বলেন, ‘বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। গানটাই এখনো উপভোগ করছি।’ প্রেমের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় তো আছেই। ছোট পরিসরে ওর দুটি গানে আমি অতিথি শিল্পী ছিলাম। বড় পরিসরে একটা অ্যালবাম করব। সেখানে ও আমার সঙ্গে কণ্ঠ দেবে। এতটুকুই। এর বাইরে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ অনেক কিছুই বলবে, আমার কিছু বলার নেই।’

আরও পড়ুন