গিনেস বুকে রুনা লায়লা ও তাঁর জীবনের নানান বাঁক

৬০ বছরের বেশি সময়ের পেশাদার সংগীতজীবন উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লার। দীর্ঘ সংগীতজীবনে গান গেয়েছেন ১০ হাজারের বেশি। গান গেয়ে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন গিনেস বুকে। ৭৩ বছর বয়সী এই সংগীতশিল্পীর আজ জন্মদিন। জন্মদিনে একনজরে জেনে নেওয়া যাক তাঁর জীবনের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক
১ / ১৪
উর্দু ছবি ‘জুগনু’তে রুনা লায়লা গান গেয়েছেন ১৯৬৫ সালের জুন মাসে। গানটি ছিল ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। পুরো এক মাস চর্চা করেন রুনা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দুই ঘণ্টা আর স্কুল থেকে ফেরার পর দুই ঘণ্টা। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন মনজুর হোসেন। তিনিই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রুনা বললেন, ‘মনজুর হোসেন সাহেব আমাকে ফিল্মে গান গাওয়ার কিছু কৌশল শিখিয়ে দেন। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে কণ্ঠ দিয়েছেন, তিনি তা ঘষেমেজে পলিশ করেন।’ দ্বিতীয় গানটিও একই ছবির। এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলান শর্মিলী আহমেদ। এরপর এখন পর্যন্ত তিনি গেয়েছেন হাজার দশেক গান। গান গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি আর উর্দু ছবিতে। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন আটবার। উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী তিনি
রুনা লায়লার সৌজন্যে
২ / ১৪
ছয় দশকের সংগীতজীবনে লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক—সব ধাঁচেই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন রুনা। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিসহ ১৮টি ভাষায় তাঁর কণ্ঠে গান শোনা গেছে। বাংলা ছাড়া আমি উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন তিনি। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছেন
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৩ / ১৪
পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুর করা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা। রুনাকে দিয়ে নানা ধরনের গান করিয়েছেন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক। পরে মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রুনাকে দিয়ে নিসার বাজমির সুর করা গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে। নব্বইয়ের দশকে এই সুরকারের ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন রুনা। পরে তা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্থান পায় গিনেস বুকে
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৪ / ১৪
অবাক করা তথ্য হচ্ছে সংগীতশিল্পী নয়, তাঁর হওয়ার কথা ছিল নৃত্যশিল্পী। টানা চার বছর করাচির বুলবুল ললিতকলা একাডেমির ভরতনাট্যম, কত্থক, কত্থকলি শেখেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত গানের মাঝেই ডুবে থাকেন। গান গেয়েই বাংলাদেশের রুনা লায়লা ভারত, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৫ / ১৪
রুনা লায়লার মঞ্চে গান গাওয়ার শুরুটা একদম হঠাৎ করেই। করাচিতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। এখানে গান করবেন দিনা লায়লা (রুনার বড় বোন)। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিনা। বিপদে পড়েন আয়োজকেরা। শেষে বড় বোনের জায়গায় ছোট বোনকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। রুনা বলেন, ‘ওই অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয়সংগীত করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ছয়। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, আমি নাকি সেদিন ধুমধাম গেয়ে মাত করেছিলাম। তানপুরা নিয়ে গান করেছিলাম। আর ওই তানপুরা ছিল আমার চেয়ে দুই গুণ বড়। সবাই আমার গানে মুগ্ধ হন। খুশি হয়ে সেদিন অনেকেই আমার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।’ ছবিতে বড় বোন দিনা লায়লা, সঙ্গে রুনা লায়লা
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৬ / ১৪
তখন রুনা লায়লার বয়স ১২। থাকতেন করাচিতে। লাহোর থেকে একটি ছবিতে গান করার প্রস্তাব আসে। কিন্তু রুনার বাবা শুনেই না করেন। সেই গল্প প্রসঙ্গে রুনা লায়লা বলেন, ‘গান গাওয়া নিয়ে আব্বার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তখন অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। আমার খুব ইচ্ছে হলো। তখন সব বড় বড় শিল্পী রেডিওতে গান করতেন। ভাবতাম, একদিন রেডিওতে আমার নামও বলবে। সবাই আমার গান শুনবে। বাবাকে আমার ইচ্ছের কথা জানান মা। অনেক কষ্ট করে তিনি আব্বাকে রাজি করালেন। আমি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম।’ ছবিতে সত্তর দশকের শেষ দিকে মুম্বাইয়ের একটি স্টুডিওতে গানের রেকর্ডিংয়ে (বাঁ থেকে) রুনা লায়লা, জয়দেব ও ভূপিন্দর সিং
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৭ / ১৪
রুনা লায়লা প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং করেন পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। দেবু ভট্টাচার্যের সুর করা গান দুটি ছিল ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ আর ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’। ছবিতে গুলাম আলী, রুনা লায়লা ও হরিহরণ
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৮ / ১৪
পাকিস্তানে যখন রুনা লায়লা ব্যস্ত হতে শুরু করেন, একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের সিনেমায়ও গাইবার প্রস্তাব পান। ষাটের দশকে প্রস্তাব পাওয়া সেই ছবিটির নাম ‘স্বরলিপি’, পরিচালক নজরুল ইসলাম আর গানের সংগীত পরিচালক সুবল দাস। এই গানের রেকর্ডিং হয় লাহোরে। রুনা লায়লাকে দিয়ে যখন ছবিটির গান রেকর্ডিংয়ের পরিকল্পনা করা হয় তখন তিনি দারুণ ব্যস্ত। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছয়-সাতটি গান রেকর্ডিং করছেন। কাজ করতেন সকাল ছয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। বাংলাদেশের সিনেমার গানটি শুনে রাজি হলেন রুনা। লাহোরের বারী স্টুডিওতে রেকর্ডিং করা হয় গানটি। গানটির শিরোনাম ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। একই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন মাহমুদুননবী। রুনা বললেন, ‘বাংলাদেশে আসার আগে আর কোনো বাংলা ছবিতে গান গাওয়া হয়নি।’
রুনা লায়লার সৌজন্যে
৯ / ১৪
বাংলাদেশে আসার পর রুনা লায়লা প্রথম গান করেন সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ ছবিতে।
ছবি : প্রথম আলো
১০ / ১৪
মা–বাবার সঙ্গে রুনা লায়লা বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। রুনা লায়লা বললেন, ‘সংগীতজগতের অনেকেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সবাই আমাকে স্বাগত জানালেন। আর বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছি, সেটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। আব্বা যখন বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তখন অনেকেই আমাকে পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। শুনিনি। তত দিনে উর্দু ছবিতে আমি অনেকগুলো গান করে ফেলেছি।’ একই বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে প্রথম ভারত সফর করেন রুনা। ভারতে প্রথম গান করেন দিল্লি বিজ্ঞান ভবনে, এরপর মুম্বাইয়ে শান মুখআনন্দ হলে। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তাঁকে বলা হয় ‘দামাদাম গার্ল’। তাঁর প্লেব্যাক করা প্রথম হিন্দি ছবি এক সে বড়কার এক। কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে তিনি ছবির টাইটেল গানে কণ্ঠ দেন। পর্দায় এই গানের সঙ্গে অভিনয় করেন হেলেন।
ছবি : প্রথম আলো
১১ / ১৪
১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর। এদিন রুনার গাওয়া বাপ্পী লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে সুপার রুনা অ্যালবাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রথম দিনেই অ্যালবামটির এক লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক। রুনা বলেন, ‘অ্যালবামটির কাজ করেছিলাম লন্ডনে। লন্ডনের এবি রোডসে, যেখানে বিটল্স গান রেকর্ডিং করত।’
ছবি : প্রথম আলো
১২ / ১৪
ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে পাকিস্তান থেকে তো বটেই, ভারত থেকেও অসংখ্য প্রস্তাব পান রুনা লায়লা। কিন্তু তখন তিনি গানকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শেষে একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ছবির নাম শিল্পী। রুনা বলেন, ‘এই ছবিটি আমার জীবনের কিছু গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাই রাজি হয়েছিলাম।’ শিল্পী ছবিটির পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। এই ছবিতে রুনা লায়লা অভিনয় করেন আলমগীরের বিপরীতে। মুক্তির পর ছবিটি বেশ আলোচনায় ছিল।
রুনা লায়লার সৌজন্যে
১৩ / ১৪
১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন রুনা লায়লা
ছবি : প্রথম আলো
১৪ / ১৪
এবারের জন্মদিন উপলক্ষে কোক স্টুডিও বাংলা রুনা লায়লার গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় গান ‘মাস্ত কালান্দার’ নতুন সংগীতায়োজনে প্রকাশিত হয়েছে। কোক স্টুডিও বাংলায় রুনা লায়লাকে পেয়ে ভক্ত–শ্রোতারা বেশ উচ্ছ্বসিত। ৬ হাজারের বেশি মন্তব্য এসেছে ইউটিউবে মন্তব্যের ঘর। ওয়ালিউল্লাহ ছোটন নামের একজন লিখেছেন, ‘৭৩ বছর বয়সী একজন শিল্পীর কণ্ঠের এমন মাধুর্যতা চিন্তা করাই যায় না। আপাদমস্তক গানের মানুষ। সুরের নির্যাস ছড়িয়ে যাচ্ছেন যুগের পর যুগ। সংগীত জগৎকে করেছেন ধন্য, দিয়েছেন পূর্ণতা। আমাদের রুনা লায়লা, আমাদের অহংকার।’ সায়ন্তন নামের একজন লিখেছেন, ‘রুনা লায়লা উপমহাদেশের প্রথম শিল্পী যিনি একই সঙ্গে গান ও নাচের প্রচলন করেছিলেন। সেই যে শুরু, আজ কোক স্টুডিওতেও গান ও নাচের মেজাজ। সত্যিই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। চোখে পানি চলে এসেছে।’
ছবি : রুনা লায়লার সৌজন্যে