শুভ জন্মদিন, লতাজি

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। বেঁচে থাকলে ৯৩ বছর পূর্ণ করতেন লতা মঙ্গেশকর। উপমহাদেশীয় সংগীতের এই কিংবদন্তির সঙ্গে বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী রুনা লায়লার ছিল চমৎকার সম্পর্ক। জন্মদিনে অগ্রজ শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন রুনা লায়লা

সময়ের হিসাবে আমাদের ৪৭ বছরের সম্পর্ক। ১৯৭৪ সালে প্রথম দেখা, পরিচয়, এরপর মাঝেমধ্যে কথাবার্তা। একটা সময় দারুণ একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় সে সম্পর্ক। নিয়মিত কথাবার্তা, নানা বিষয়ে আলাপ, উপহার আদান–প্রদান, মুম্বাইয়ের বাড়িতে ঘণ্টার পর আড্ডা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সম্পর্কটা ছিল আন্তরিক, সৌহাদ্যপূর্ণ ও পারিবারিক।

১৯৭৪ সালের নভেম্বরে আমাদের প্রথম দেখা। ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার ফর রিলেশনসের আমন্ত্রণে ভারতে গিয়েছিলাম। তিনটি অনুষ্ঠান করেছিলাম সেবার; প্রথমটি দিল্লি, দ্বিতীয়টি মুম্বাই আর শেষটা কলকাতা। আয়োজকেরা সেবার আমার কাছে জানতে চান, এমন কেউ কি আছেন, যাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই? বললাম, কোনোভাবে কি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দেখা করা যায়? তাঁরা জানালেন, ‘তিনি তো কোথাও যান না। তবু চেষ্টা করব।’ কথা শুনে ধরেই নিয়েছিলাম, দেখা হবে না।

মুম্বাইয়ের সম্মুখানন্দ হলের পেছনে মহড়া করছি। হঠাৎ দেখি, পেছন দরজা দিয়ে কয়েকজন ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। একজনের পরনে সাদা শাড়ি, দেখে লতাজি লতাজি মনে হচ্ছিল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! আর মঞ্চের পেছন দিয়েই–বা কেন ঢুকবেন তিনি? তারপর দেখি, সত্যি সত্যিই লতাজি। লাল গোলাপ হাতে আমার দিকেই আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সালাম করলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ফুল দিলেন। এর মধ্যে সাংবাদিকেরা খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা এসে ছবি তুললেন। পরদিন পত্রিকায় শিরোনাম, ‘ওয়ান নাইটিঙ্গেল মিটস অ্যানাদার’। সেদিন অনেকক্ষণ বসে কথা বলেছিলাম আমরা।
লতাজির সঙ্গে দেখা হবে, এটা তো স্বপ্ন ছিল। ছোটবেলা থেকে তাঁর গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। শেখার চেষ্টা করেছি। তাঁর সঙ্গে কখনো দেখা হবে, এটা চিন্তা করতাম, ভাবতাম। ১৯৭৪-এ স্বপ্নটা যখন সত্য হলো, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমার অনুষ্ঠান পুরোটা দেখলেন। তারপর মাঝেমধ্যে যখনই মুম্বাই যেতাম, তাঁকে ফোন করতাম। কথা হতো। গেল ১০-১২ বছরে তাঁর সঙ্গে খুব আন্তরিকতা হয়ে গেল। খুব আপন হয়ে গেলাম। তিনিও আমাকে খুব আদর করতেন।

ঊষা মুঙ্গেশকর, রুনা লায়লা, লতা মুঙ্গেশকর

তবে সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠই হোক, লতাজিকে কিন্তু একটু ভয়ও পেতাম। এত বড়মাপের শিল্পী! মুম্বাই গেলে ভাবতাম, দেখা করতে চাইলে রাজি হবেন কি না। আদৌ দেখা করবেন কি না। কিন্তু যখনই দেখা হয়েছে, খুবই ভালো ব্যবহার করতেন। আদর করতেন। তারপরও কেন যেন ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলতাম, মাঝেমধ্যে কথা আটকে যেত। ১০ বছর আগে প্রথম তাঁর বাড়িতে গেলাম। চা-নাশতা খাওয়ালেন। অনেকক্ষণ ধরে গল্প হলো। আমার কাছ থেকে গল্প শুনলেন, অনেক গল্প তিনিও বললেন।

আমার জন্মদিনে তিনি উইশ করতেন। উপহার হিসেবে শাড়ি পাঠাতেন। আমিও ফোন করে উইশ করতাম। জামদানি শাড়ি উপহার পাঠাতাম। শাড়ি পেলে খুব খুশি হতেন। একবার পিংক পার্লের একটা গয়নার সেট নিয়ে গিয়েছিলাম, ছোট্ট একটা সেট, জাস্ট টোকেন, দেখে এত খুশি হলেন! ভাতিজাকে বললেন, ‘এটা আমাকে এখনই পরিয়ে দাও। পার্ল আমার খুব পছন্দ।’ পরে আমাদের পার্ল পরে বসলেন। আড্ডা দিলেন।

একটা সময় সম্পর্কটা একেবারে পারিবারিক হয়ে গেল। ২০১৯ সালে লেজেন্ডস ফরএভার অ্যালবামের রেকর্ডিংয়ে মুম্বাই গেছি। দেখা করতে চাইলাম। দুবার সময়ও দিলেন। কিন্তু শরীরটা খারাপ থাকায় দেখা হলো না। সেবার আমি, আমার ভাই, ভাইয়ের বউ, আলমগীর সাহেব—চারজন গিয়েছিলাম। দেখা করতে না পারলেও প্রত্যেকের জন্য কিন্তু উপহার পাঠিয়ে দিলেন। আমার ভাই ও আলমগীর সাহেবের জন্য ঘড়ি আর আমাদের দুজনের জন্য শাড়ি। এক জন্মদিনে তাঁর নাম দেওয়া ঘড়ি দিলেন। ঢাকায় ফিরে আসার পর ফোন করে, দেখা হলো না বলে কত আফসোস করলেন!

হোয়াটসঅ্যাপে লতাজির সঙ্গে প্রায়ই আমার মেসেজ আদান–প্রদান হতো। গান পাঠাতেন। আমিও পাঠাতাম। একদিন মেসেজ পাঠালেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, কাছের কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলছি।’ সব সময় আপনি আর রুনাজি বলে সম্বোধন করতেন। কোনো সময় নাম ধরে ডাকতেন না, বললেও শুনতেন না। আমাদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হতো। অনেক রকমের আলাপ হতো। তাঁর অভিজ্ঞতা শুনতাম, খুব ভালো লাগত। কোন রেকর্ডিংয়ে কী করলেন, না করলেন, এসবও শুনতাম। এসব আমার লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স।

আজ যদি বেঁচে থাকতেন, ফোন করে আজও বলতাম, শুভ জন্মদিন দিদি। তিনি খুশি হতেন। জামদানি শাড়ি উপহার পাঠাতাম। তাঁর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে অনেক অডিও আদান–প্রদান হতো। মাঝেমধ্যে ফোনটা হাতে নিলে চোখ বোলাতে বোলাতে দেখি। শুনি। ভীষণ মন খারাপ হয়। তাঁর চলে যাওয়ায় মনে হয়, কাছের কেউ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। একজন লতা মঙ্গেশকর আমার কাছে কী ছিলেন, আমিই শুধু জানি। তাঁকে মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা আমার নেই। শুধু মনে হয়, গানের জন্যই তিনি জন্মেছিলেন। যেসব গান রেখে গেছেন, অনেকেই সেগুলো গেয়ে থাকেন, তবে যত চেষ্টাই করুক, ধারেকাছেও যেতে পারবেন না। লতা মঙ্গেশকর লতা মঙ্গেশকরই। তিনি একজন। এক ও অদ্বিতীয়।