অন্ধকারের উৎস থেকে আলো উৎসারিত হবেই

অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের পুরোনো আয়োজন ও নতুন রেকর্ড করা পরিবেশনার সমন্বয়েফাইল ছবি

পঞ্জিকার শাসন মেনে এবারও নতুন বছর এসেছে। বাংলা ১৪২৭ সালের সূর্য ডুবে হেসেছে ১৪২৮ সালের সূর্য। কিন্তু আজ মানুষ মিলেনি রমনার বটমূলে। ১৯৭১ সালের পর গত বছর প্রথমবার বছরের প্রথম প্রহরে রমনার বটমূলে গান শোনায়নি ছায়ানট। সেখানে গানে গানে এবারও করা হয়নি নতুন বছরের বন্দনা। তবে অনলাইনে একটি অনুষ্ঠান করেছে ছায়ানট, যেটি সম্প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে। অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে মানুষের মঙ্গল কামনা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে উজ্জীবনী গান, বাণী ও কথন দিয়ে।

ছায়ানট সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের বক্তব্য মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

আজ সকাল সাতটায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় বর্ষবরণের এ আয়োজন। অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের পুরোনো আয়োজন ও নতুন রেকর্ড করা পরিবেশনার সমন্বয়ে। গান, আবৃত্তিতে মানুষের মঙ্গল কামনা ছাড়াও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ছিল দেশাত্মবোধক গানের পরিবেশনা। ছায়ানট সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের বক্তব্য এবং সবশেষে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। এ সময় সন্‌জীদা খাতুন আশা করেন, অন্ধকারের উৎস থেকে আলো উৎসারিত হবেই, নতুন বছর বয়ে আনবে সর্বজনের জন্য মঙ্গলবার্তা। তাঁর ভাষায়, ‘আলো আসবেই।’

সন্‌জীদা খাতুন বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ বাঙালি জীবনে নিছক নববর্ষ উদ্‌যাপন নয়। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বাঙালি যে পথপরিক্রমায় অংশ নিয়েছে, সে পথ মসৃণ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, নববর্ষের আয়োজন সর্বধর্মের বাঙালিকে ঐক্যসূত্রে যুক্ত করে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লক্ষ প্রাণের আত্মদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সংস্কৃতির যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন হয়েছে বলা যায়। অর্ধশতবর্ষ পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ঈর্ষণীয় সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি আমাদের আশাবাদী করে তোলে।’

অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের পুরোনো আয়োজন ও নতুন রেকর্ড করা পরিবেশনার সমন্বয়ে
ফাইল ছবি

সন্‌জীদা খাতুন তাঁর কথনে আরও বলেন, ‘ধর্মের মর্মবাণীকে উপেক্ষা করে নতুন অবয়বে উত্থিত ধর্মবিদ্বেষ সম্প্রীতির সমাজকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। লোভের বিস্তার বৈষম্য সৃষ্টি করছে। খণ্ড–বিচ্ছিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে সামাজিক অবক্ষয়ের। দেশের অগ্রযাত্রাকে অক্ষুণ্ণ রেখে নেতিবাচক প্রবণতাকে রোধ করার জন্য অতীতের মতো বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার প্রসার, মানবিক সমাজ গঠনের এক অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে।’

ইউসুফ আলী খানের সরোদ বাদনে শুরু হয় অনুষ্ঠান। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পূর্বগগনভাগে দীপ্ত হইল সুপ্রভাত’ সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। আব্দুল ওয়াদুদ ও সেঁজুতি বড়ুয়া একক কণ্ঠে পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘অন্ধকারের উৎস হতে’ ও ‘আমি ভয় করব না’।

ছোটদের দল সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করে কাজী নজরুল ইসলামের ‘এলো এলো রে বৈশাখী ঝড়’। পরে একক কণ্ঠে খায়রুল আনাম শাকিল গেয়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘গগনে প্রলয় মেঘের ভেলা’ এবং ফারহানা আক্তার গেয়ে শোনান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের শেষাংশে ‘শুভেচ্ছা কথনে’ অংশ নেন ছায়ানট সভাপতি সন্‌জীদা খাতুন l
ফাইল ছবি

ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতাটি। নাসিমা শাহীন গেয়ে শোনান জয়দেব সেনের ‘এই বাংলার মাটিতে মাগো’, রেজাউল করিম গেয়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘স্বদেশ আমার জানি না তোমার’। অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয় লালন শাহ রচিত ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত’, আবুল কালাম আজাদ গেয়ে শোনান শাহ আবদুল করিমের ‘জীবন আমার ধন্য যে হয়’ এবং সম্মেলক কণ্ঠে সলিল চৌধুরীর ‘ও আলোর পথযাত্রী’।
১৯৬৭ সাল থেকে রাজধানীতে রমনার বটমূলে নববর্ষের সূচনা হয়ে আসছে ছায়ানটের প্রভাতি গানের আসর দিয়ে। এই বটমূলের সন্ধান দিয়েছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী নওয়াজেশ আহমদ। এর আগে বিভিন্নভাবে নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণের আয়োজন করত। ধীরে ধীরে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষবরণ উৎসব একটি কেন্দ্রিকতা পায়। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া এ আয়োজন নিয়মিত হয়ে এসেছে। গত বছর করোনার কারণে অনুষ্ঠানটি হয়নি।