এক ক্লিকে ফিরোজা বেগম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে শুভকামনা জানিয়েছিলেন। ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একদিন তিনি বড় শিল্পী হবেন। তিনি শুধু বড় শিল্পীই হননি, নজরুলসংগীতের সবচেয়ে বড় পোস্টার তিনি। নজরুলের আদর্শ কণ্ঠে ধারণ করে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। তিনি ফিরোজা বেগম। এই শিল্পীরই আদ্যোপান্ত নিয়ে করা হয়েছে আর্কাইভ।
ফিরোজা বেগমকে নিয়ে আর্কাইভ
গত ২৮ জুলাই ছিল এই শিল্পীর জন্মদিন। দিনটিতে একটি চমৎকার উদ্যোগের যাত্রা শুরু হলো। এসিআই ফাউন্ডেশনের আয়োজনে শুরু হলো ফিরোজা বেগম আর্কাইভের। অনলাইনে ফিরোজা বেগমের গান থেকে জীবন—সবকিছুরই খোঁজ পাওয়া যাবে এখানে। শুধু দর্শক–শ্রোতাই নয়, শিল্পীদের কাছেও ফিরোজা বেগমের গান প্রিয়। শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্যের মতে, অনেক সময়েই নজরুলসংগীত ভুল কিংবা বিকৃত সুরে গাওয়া হয়েছে। আসল সুর জানতে এই আর্কাইভের গুরুত্ব অনেক।
চলুন, ঘুরে আসা যাক ferozabegum.com আর্কাইভ থেকে।
জীবনী
ফিরোজা বেগমের গাওয়া 'শাওন রাতে যদি' নজরুলসংগীতটির রেকর্ড ১০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল এক মাসে। এমন ঘটনায় শিল্পীকে রেকর্ডিং কোম্পানি সিবিএস 'গোল্ডেন ডিস্ক' পুরস্কারে ভূষিত করে। শুধু তাই নয়, স্বয়ং নজরুলের কাছে গান শিখেছিলেন তিনি। বিখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তর সঙ্গে সংসার বাঁধেন। নজরুলের গানকে শুধু কণ্ঠেই নয়, জীবনে ধারণ করেছিলেন। একমাত্র নজরুলসংগীত গাইবেন বলে অন্য গান গাওয়াও ছেড়ে দেন। এমনকি চলচ্চিত্রের জন্যও গাননি তিনি। ফিরোজা বেগমের এই বর্ণিল জীবন দেখা যাবে আর্কাইভের শুরুতেই 'বায়োগ্রাফি' ট্যাবে। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষায়ই পাওয়া যাবে তাঁর জীবনী। পাশাপাশি এই ট্যাবেই পাওয়া যাবে তাঁকে দেওয়া সম্মাননা ও পুরস্কারের খবর।
সংগীত
এই ট্যাব নজরুলসংগীতপ্রেমীদের জন্য থাকবে আগ্রহের কেন্দ্রে। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ধারণ করা গানগুলো শোনা যাবে এখানে। একক গান থেকে অ্যালবাম কিংবা রবীন্দ্রসংগীত, কাব্যগীতি ও গজল—পাওয়া যাবে সব। এ ছাড়া মিশ্র অ্যালবাম, একক গান, আধুনিক গানও পাওয়া যাবে এখানে। সত্তর ও আশির দশকে আইএনএস, এইচএমভি, আরপিজিসহ বিভিন্ন মিউজিক লেভেল থেকে বের হওয়া অ্যালবামের গানগুলোও শুনতে ঢুঁ মারতে হবে এখানেই। ট্যাবটির নাম রাখা হয়েছে 'মিউজিক'।
অনুষ্ঠান
নজরুলের স্মৃতিবিভ্রম প্রায় শুরু হয়েছে। সেই অবস্থায় হঠাৎ একদিন কবি এসে উপস্থিত হলেন কমল দাশগুপ্তর ঘরে। বসে বললেন, 'কমল, দেখি তো খাতাটা। অনেক দিন তোমাকে গান দেওয়া হয় না। গান দিয়ে যাই আজকে।' কবিকে খাতাটা এগিয়ে দিলেন কমল দাশগুপ্ত। খাতা দেওয়ার পরে চুপচাপ শান্তভাবে গান লিখলেন। অনেক কাটাকুটি করলেন। সচরাচর কাজী নজরুল ইসলাম এটা করেন না। গান কাটাকাটি ও পরিবর্তন খুব কম করেছেন তিনি। কমল দাশগুপ্ত লক্ষ করলেন কোনো দিনও কবি এত কাটাকুটি করেন না। গান লেখা হয়ে গেলে কমল দাশগুপ্তর দিকে খাতাটি দিয়ে কবি বললেন, 'এই নাও গান। অনেক দিন তো গান লিখি না তোমার জন্য। শরীরটা ভালো লাগছে না।' গানটা পড়ে কমল দাশগুপ্ত অবাক। কী ভয়ংকর কথা। তিনি বললেন, 'কাজীদা এই গানটাই আপনি লিখলেন'! কবি বললেন, 'হ্যাঁ রে, এইটা ছাড়া আর মনে কিছু এল না। হঠাৎ আজকে মনে হলো তোমাকে অনেক দিন গান দেওয়া হয় না। তাই এসেছি।' এ রকম নিজে ইচ্ছা করে কখনো আসেন না তিনি। গানটা পড়ে কমল দাশগুপ্ত হতবাক। কয়েকটা জায়গায় কথা মেলেনি। কয়েকটা লাইন কেটে পুনরায় লিখেছেন। গানের বক্তব্য এ কী! নিজের কথা নিজেই গানের ভেতর দিয়ে বলে দিলেন।
কবির লেখা সেই গান ছিল 'খেলা শেষ হলো, শেষ হয় নাই বেলা। কাঁদিও না কাঁদিও না—তব তরে রেখে গেনু প্রেম-আনন্দ মেলা।' যেন শেষ জীবনের কথাই গানে গানে বলে গেলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিখ্যাত সব নজরুলসংগীতের পেছনের গল্প নিজের মুখে স্মৃতিচারণা করেছেন সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। ওয়েবসাইটটির প্রোগ্রাম সেকশনের 'ইন্টারভিউ'–এ দেখা মিলবে গান সৃষ্টির পেছনের এসব গল্প। এ ছাড়া ফিরোজা বেগমের অংশগ্রহণে টেলিভিশন, রেডিও ও মঞ্চের অনুষ্ঠানগুলো পাওয়া যাবে। আছে রেকর্ড ও লাইভ দুই ধরনের অনুষ্ঠান। ফিরোজা বেগমকে নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোও থাকছে এখানে। থাকছে তাঁর এবং তাঁকে নিয়ে গুণীজনদের সাক্ষাৎকারও।
গ্যালারি
ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ফিরোজা বেগমের। ওয়েবসাইটটির গ্যালারিতে গেলে সে ছবি মিলবে। ১৯৭৩ সালে নজরুলজয়ন্তীতে তাঁর সংগীত স্কুল কলগীতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গান গাইছিলেন। সেই ছবি আছে। ১৯৭২ সালে কলকাতার সংগীতকলা মন্দিরের গান গাওয়ার ছবিও আছে এখানে। আছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তোলা ছবি। আর্কাইভের এই অংশটিতে থাকছে ছবিতে ফিরোজা বেগমের জীবন। 'সিঙ্গেল ফটো', 'ফ্যামিলি লাইফ', 'সিঙ্গিং ক্যারিয়ার', 'উইথ মেস্ত্রো' ট্যাবের ছবিতে পাওয়া যাবে ফিরোজা বেগমের সেই সব দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ।
সংগীত বই
ডায়েরির একটি পাতায় তারিখটা ১৯৭৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। সেখানে লেখা নজরুলের গান 'উচাটন মন ঘরে রয় না (পিয়া মোর)'। ওপরে লেখা গান নিয়ে খুঁটিনাটি। যেমন—কাহার্বা তাল। ঠিক তার পরের দিনের ডায়েরিতে লেখা 'ওরে নীল যমুনার জল, বল রে মোরে বল'। সেখানেও গানটি কোন ঘরানার সেটি লেখা। 'কীর্তন' লিখে, তার পাশে তাল লেখা হয়েছে দাদরা। ওয়েবসাইটটির 'সং বুক' একটা অসাধারণ ট্যাব। এখানে ফিরোজা বেগমের ডায়েরিতে লেখা নজরুলসংগীতের কপি দেখার সুযোগ মিলবে। নজরুলসংগীতের কথার সঙ্গে থাকছে স্বরলিপিও। শুধু নজরুলসংগীত নয়, রবীন্দ্র ও আধুনিক গানের কথা ও স্বরলিপিও থাকছে। শুধু তাই নয়, তাঁর স্বামী বিখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তর গান ও কাজ মিলবে এখানে। রুলটানা কাগজে কমল দাশগুপ্ত লিখেছিলেন গান ও নোটেশন। সেই খাতার এক কোনায় লাল কালিতে লেখা ১৯৪১। এত দিন আগের কলম ও পেনসিলে লেখা ওই নোটেশন নিঃসন্দেহে সংগীতপিপাসুদের জন্য দারুণ কিছু।
নজরুলসংগীত ও ফিরোজা বেগম মিলেমিশে একাকার। এই সংগীতশিল্পীকে কাছ থেকে দেখার সবচেয়ে বড় জায়গা হতে পারে এই ওয়েবসাইট। সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষকে নিয়ে এমন আয়োজন হয়নি বললেই চলে। শেষ করা যায় ফিরোজা বেগমের মিউজিক কো–অর্ডিনেটর চিন্ময়ী চক্রবর্তীকে লন্ডন থেকে লেখা একটি চিঠির অংশ দিয়ে। ফিরোজা বেগমকে পাঠানো কিংবা ফিরোজা বেগমের লেখা এমন চিঠিও পাওয়া যাবে এখানে।
স্নেহের চিন্ময়ী,
'প্রিয়জন যখন দূরে চলে যায় তারা আরো প্রিয় হয়, আমি এই শুধু জানি। যার জন্য কাঁদার কেউ নেই। দুঃখ করার কেউ থাকে না, সে বিদায় কত সুখের, কত নিশ্চিন্তের। এমন মানুষও আছে। তবে খুঁজতে হয়। সবাই চায় তার অভাবে, অনুপস্থিতিতে পরিবার–পরিজন কাঁদুক। অসহায়বোধ করুক। জীবদ্দশায় তার পরিশ্রম ও কর্তব্যপালনের সার্থকরূপ এটাই। কিন্তু যারা গান মনে রাখার মিনতি জানিয়ে যায়, তারা কোন পর্যায়ে পড়ে? অসহায় না অবাস্তব? স্বপ্ন রাজ্যটা কেন যে পৃথক হোলো না!'
চিঠির শেষে লেখা—দিদি, ১৭–১১–৮৮।