একে একে নিভিছে দেউটি

সুরশিল্পী আলাউদ্দীন আলীকে নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। ছবি: সংগৃহীত
সুরশিল্পী আলাউদ্দীন আলীকে নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। ছবি: সংগৃহীত

আমার দীর্ঘদিনের এক সহযাত্রী, আমাদের সংগীতজগতের এক অসাধারণ প্রতিভাধর সুরের কারিগর, এই উপমহাদেশের এক শ্রেষ্ঠ সুরশিল্পী আলাউদ্দীন আলী চলে গেলেন।

যিনি ছবি আঁকেন তিনি চিত্রকর, যিনি গীত রচনা করেন তিনি গীতিকার, যিনি সুর রচনা করেন তিনি সুরকার; কিন্তু চিত্র অঙ্কনকে যিনি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেন, তিনিই চিত্রশিল্পী। যিনি গীত রচনাকে কাব্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন, তিনি লাভ করতে পারেন গীতিকবি অভিধা এবং যিনি সুর রচনাকে শিল্পশৈলীতে সমৃদ্ধ করতে পারেন, তিনি সুরশিল্পী বা সুরস্রষ্টা। আলাউদ্দীন আলী ছিলেন তেমনই একজন সুরশিল্পী। সুরের রং দিয়ে তিনি অন্তরের বিমূর্ত ভাবনাগুলোকে মূর্ত করে তুলতে পারতেন। ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়’ বা ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’ গানের মধ্যে স্বদেশ–প্রকৃতির প্রতি যে বিমুগ্ধতা–তন্ময়তা অথবা ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’ গানের মধ্যে যে স্বজন হারানোর বেদনাবোধ, তা যেন সুরের রংতুলিতে আঁকা একেকটি ছবি। বাংলা দেশপ্রেমের গানের ভান্ডারে এসব গান ভাস্বর হয়ে থাকবে।

চলচ্চিত্রের গান সাধারণভাবে চলচ্চিত্রের কোনো বিশেষ দৃশ্যের অনুগামী বা সহায়ক, কিন্তু আলাউদ্দীন আলী চলচ্চিত্রের গানকেও মৌলিক গানের মতোই স্বতন্ত্র শিল্প–সুষমা মণ্ডিত করে তুলেছেন, এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উচ্চাঙ্গসংগীত ও লোকসংগীতের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে আধুনিক আঙ্গিকের এক সূক্ষ্ম সংমিশ্রণে তিনি বাংলা গানে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গানে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে গেছেন; যা সম্পূর্ণভাবেই তাঁর নিজস্ব ঘরানা। ‘আছেন আমার মুক্তার’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না’, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’ বা ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, এমন আরও বহু গান তাঁর এ ঘরানারই ফসল।

সুরশিল্পী আলাউদ্দীন আলী।ছবি: সংগৃহীত
সুরশিল্পী আলাউদ্দীন আলী।ছবি: সংগৃহীত

আলাউদ্দীনের কম্পোজিশন বা সুর বিন্যাসের আরেকটি অনন্য দিক হচ্ছে তাঁর মেলোডি বা সুর–কলি নির্মাণের দক্ষতা। তাঁর গানের মূল মেলোডির মতো ইন্টারলিউডও (গানের মধ্যবর্তী বা বিশ্রামকালের সংগীত) শ্রোতার মনে গেঁথে থাকত। ওপরে উল্লিখিত গান কটির বা ‘এমনও তো প্রেম হয়’ গানটির ইন্টারলিউড সমানভাবে মূল গানের মতোই জনপ্রিয়। এই রীতিটি উপমহাদেশের গানে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গানে লক্ষণীয় এবং অবশ্যই দক্ষতার দাবিদার। এ প্রসঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘তুমি যে আমার’ গানটি এবং শঙ্কর জয়কিষণের সুরে বিখ্যাত গান ‘এ্যায় মেরি দিল কহি অউর চল’ গানটির উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব গানের ইন্টারলিউড আজও শ্রোতার অন্তরে মূল গানের মতোই অনুরণন তোলে।

আলাউদ্দীন আলী পুরো সত্তর দশকটি মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর এই ঘরানার সম্মোহনী সুরের মায়াজালে। এই সাফল্যের পেছনে ছিল তাঁর অধ্যবসায়, শ্রম এবং মেধা। সংগীত পরিবার থেকে এসেছেন তিনি এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনও ছিলেন সংগীত পরিবারের। ফলে এক সংগীত আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নিয়েছেন পরিবারেরই গুণীজনদের কাছে। সেই তালিমকে তাঁর অসাধারণ মেধা দিয়ে আত্মস্থ করেছেন। সেই সঙ্গে দেশ–বিদেশের বৃহত্তর সংগীতজগতের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন, নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন।

কিশোর বয়স থেকেই বেহালা বাজাতেন ঢাকা অক্রেস্ট্রাতে। এই সুবাদেই তিনি সে সময়ের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক—সুবল দাস, আলী হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান, খন্দকার নুরুল আলম, সত্য সাহা, আনোয়ার পারভেজের মতো গুণীদের সংস্পর্শে এসেছেন, দেখেছেন, শিখেছেন। আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে তিনি সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। আমিও তখন সংগীত পরিচালক সুবল দাসের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। তাঁর কাছেই আমার সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি। তিনি চাইতেন, সংগীত পরিচালনার কাজটিও আয়ত্ত করি। সুর করিয়েছেন, চলচ্চিত্রে আবহ সংগীত করিয়েছেন পাশে বসে থেকে। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যেতে হলো, কারণ এই কাজের সূত্র ধরেই আলাউদ্দীনের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা।
যদ্দূর মনে পড়ে, সুরকার হিসেবে আলাউদ্দীন আলীর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত ‘ও আমার বাংলা মা তোর রূপের সুধায়’ গানটির মধ্য দিয়ে। গানটি গেয়েছিলেন লীনু বিল্লাহ। পরবর্তী সময়ে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে গানটি একটি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয় এবং দারুণ জনপ্রিয় হয়ে যায়। এভাবেই আলাউদ্দীন ‘এলেন এবং জয় করলেন’। পরের ইতিহাস তাঁর বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার, আমাদের গানের জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার।

আলাউদ্দীন আলী, আমজাদ হোসেন– এখন দু’জনই প্রয়াত। ছবি: সংগৃহীত
আলাউদ্দীন আলী, আমজাদ হোসেন– এখন দু’জনই প্রয়াত। ছবি: সংগৃহীত

আলাউদ্দীনের সঙ্গে আমার একটি চমত্কার বোঝাপড়া ছিল। তাঁর সুরের বিন্যাস এবং অন্তর্নিহিত আবেগটি যেমন আমি সহজেই বুঝতে পারতাম, তেমনি তিনিও আমার কণ্ঠের, তথা গায়কির ধরনটি বুঝতে পারতেন এবং তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারতেন। মনে আছে, ‘আছেন আমার মুক্তার’ গানটি রেকর্ড করার সময় আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কারণ, স্বরগ্রামের তিনটি ধাপে বিস্তৃত, দ্রুতলয়ের বা গতির গানটি গাওয়া একটু কঠিনই ছিল। আমি তাঁকে গানের লয়টি একটু কমিয়ে, স্কেলটিও একটু নামিয়ে দিতে বললাম। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘আপনি পারবেন, এভাবেই গাইতে হবে।’ আরেকবার মনে আছে, চলচ্চিত্রের একটি অতি নাটকীয় দৃশ্যের গান রেকর্ডিংয়ে রাত প্রায় ভোর হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আলাউদ্দীন এবং পরিচালক আমজাদ হোসেন কিছুতেই আমাকে ছাড়ছেন না, কারণ তাঁদের কান্না পেতে হবে। অবশেষে তাঁদের কান্না পেল, আমিও ছাড়া পেলাম। এভাবে সব শিল্পীরই সর্বোচ্চটুকু বের করে আনতে পারতেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতা।
‘একে একে নিভিছে দেউটি’, স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে যে কজন তরুণ আমাদের সংগীত অঙ্গনে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই চলে গেছেন। আলাউদ্দীনও চলে গেলেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু বেঁচে থাকবেন তাঁর সুরের মায়াজালে বিমুগ্ধ সংগীতপ্রেমীর অন্তরে চিরকাল।