ও বন্ধু আমার...
আজ আমার বন্ধু আজম খানের জন্মদিন। আমার জন্ম পঞ্চাশ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আর আজম খানের ২৮ ফেব্রুয়ারি। মাত্র কয়েক দিনের ছোট আজম খান। ছাত্রজীবনে আমরা দুজনেই ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সদস্য হিসেবে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে সংগীতবলয়ে প্রবেশ করি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, গণশিল্পী নিজামুল হক, মনিরুল আলম মনুর নেতৃত্বে ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের মঞ্চে গণসংগীত পরিবেশন শুরু করি। ছুটে বেড়াই পল্টন থেকে লালদীঘি ময়দান। মহান গণ-অভ্যুত্থান কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধে আমরা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করি। আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আর বন্ধু আজম খান আগরতলা মেলাঘর রণাঙ্গনে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আমরা দুজনেই একুশে পদকে ভূষিত হয়েছি।
যাক সে প্রসঙ্গ, আজ এই মহান মুক্তিযোদ্ধা পপগুরু আজম খানের ৭১তম জন্মদিনে আমি তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। কারণ, আজম খান একজন শিল্পী, পপসম্রাট কিংবা একটি নাম নয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস বাংলা গানের সামাজিক-সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আজম খান একটি ঘটনা। একটি অধ্যায়, যা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা বা ভুলে যাওয়া যাবে না।
আজ তিনি নেই, কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে তাঁর কর্ম, তাঁর চেতনা থাকবে নতুনত্বের পথে আলোর মশাল হয়ে। মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সর্বোপরি একজন মানবিক মানুষ আজম খানের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি বাংলাদেশের অগণিত ভক্ত–শ্রোতাকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে ২০১০ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁর ৬০তম জন্মদিন আমরা উদ্যাপন করেছিলাম, বন্ধু হিসেবে তাঁর মুখে জন্মদিনের কেক তুলে দিয়েছিলাম, যে স্মৃতি আজ কেবল কাঁদায়। বন্ধু হারানোর বেদনায় আমার আকাশটা কেবল মেঘলা হয়ে যায়। আমি আগেই উল্লেখ করেছি ষাটের দশকে আমাদের গণসংগীতে অংশগ্রহণের কথা।
আর মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের গানের ভুবনে আজম খান হয়ে ওঠেন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তাঁর গড়া ব্যান্ড উচ্চারণ হয়ে ওঠে তরুণ প্রজন্মের কাছে এক জনপ্রিয় নাম। সেই সময় বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সুরের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটে আজম খানের সঙ্গে। আমি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পরবর্তী পর্যায়ে পিলু মমতাজ সংগীত ভুবনে পপসংগীত নামে এক আধুনিক ধারার সূচনা করি। যার ধারাবাহিকতায় আজকের ব্যান্ড সংগীত।
এমনিতেই পপসংগীত জনপ্রিয় ছিল, তার সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের টেলিভিশন থেকে প্রচারিত সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানে আমরা অংশগ্রহণ করে দেশব্যাপী একদিকে যেমন পপ গানকে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, অন্যদিকে আমরা ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করি। এ প্রসঙ্গে আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা থেকে উল্লেখ করতে চাই তার চুম্বক অংশটুকু। বাংলাদেশের একজন আজম খান। বিশ শতকের বাংলা গানের ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন বা লিখবেন, তাঁরা ’৭৩, ’৭৪ সালের ঘটনার কথা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। বিশেষ করে একজন আজম খানের কথা। কোনো অসাধারণ গায়ক নন আজম খান। কিন্তু এমন একধরনের গান তিনি আমাদের সেকালে শুনিয়েছিলেন, যে গান এ দেশে আগে কেউ শোনেনি। গানগুলোর কথা, সুর, ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনের রীতি সবই ছিল আলাদা। এ কারণেই আজম খান একজন শিল্পী বা একটি নামমাত্র নয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বাংলা গানের সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আজম খান একটি বিস্ময়কর জাদুকরের নাম। সেই সময়ে একদিকে উচ্চারণ, অন্যদিকে স্পন্দন বাংলা রক সংগীতের ক্ষেত্রে এক বিশেষ অবদান রাখে।
আজ তিনি নেই, নেই কমলাপুরে, নেই মনোমিতা চিটাগাং হোটেলের আড্ডায়, তারপরও তিনি আছেন তাঁর সরলতা সহজ মানুষের আবরণে। তিনি বেঁচে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লড়াইয়ের ময়দানে। তাঁর মৃত্যু নেই, অজেয় অমর আজম খান। পদ্মা মেঘনা যমুনার কূলে কূলে যে জনবসতি তারা জানে আজ তাঁর জন্মদিন। ফুল পাখি নদী জানে জন্মদিন তাঁর। সালেকা মালেকা কিংবা আলাল ও দুলাল ও জানে জন্মদিন তাঁর।
মানুষ হিসেবে আজম খান ছিলেন অতি সাধারণ একজন মানুষ। সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। সাধারণ জীবনযাপন তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছিল। তাঁর অবদানের কথা এই জাতি কোনো দিনও ভুলবে না। আমি জানি এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর কথা তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাঁর সঙ্গে আমার স্মৃতি বহু বছরের। পরিশেষে বলতে চাই, আজম খান আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন বন্ধু। ভালো থাক আমাদের ভালোবাসা।