চট্টগ্রামে সংগীতের মিলনমেলা

সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ এর আয়োজন মাসব্যাপী প্রথম জাতীয় উৎসব ও সম্মেলনে চট্টগ্রামে (বাম থেকে) কুমার বিশ্বজিৎ, শহীদ মাহমুদ, কে এম খালিদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও নকীব খানজুয়েল শীল

উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে আধুনিক। রবীন্দ্রসংগীত, জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান থেকে ব্যান্ডসংগীত। ছিল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীদের পরিবেশনা। একের পর এক বিচিত্র গানের সুরের মূর্ছনা তৈরি করেছেন শিল্পীরা। গতকাল শুক্রবার সংগীতের এক বড় আয়োজনের সাক্ষী হয়ে রইল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

বছরের পর বছর কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকারেরা নানা অনিয়ম, অবহেলা আর প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। এ নিয়ে ছিল তাঁদের বিস্তর অভিযোগ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীরা ২০২১ সালের জুলাই মাসে একত্র হন। গঠিত হয় ‘সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ’। সে সময় করোনা সতর্কতার কারণে শুধু অনলাইনভিত্তিক সভা, আলোচনা চালিয়ে যান প্ল্যাটফর্মটির উদ্যোক্তারা। নিজেদের অবস্থান এবং উদ্দেশ্য জানানোর লক্ষ্যে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ আয়োজন করেছে মাসব্যাপী প্রথম জাতীয় উৎসব ও সম্মেলন।

সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের আয়োজনে মাসব্যাপী প্রথম জাতীয় উৎসব ও সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগীত ভবনের শিল্পীরা
ছবি : জুয়েল শীল

‘সংগীতে সখ্যে অভিন্ন লক্ষ্যে’ শিরোনামে গতকাল চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের সম্মেলন। জেলা শিল্পকলা একাডেমি চট্টগ্রাম মিলনায়তনে বিকেলে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন গীতিকবি সংঘের সভাপতি শহীদ মাহমুদ, সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক কুমার বিশ্বজিৎ এবং মিউজিক কমপোজার্স সোসাইটির সভাপতি নকীব খান।

আয়োজকেরা যা বললেন

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের সভাপতি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

সভাপতিত্ব করেন সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের সভাপতি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
ছবি : প্রথম আলো

তিনি বলেন, ‘আসলে যেকোনো বিপদে ও সংকটে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। আমাদের তিনটি আলাদা সংগঠন হলেও এক হয়ে এর মধ্যে অনেক কাজ করেছি আমরা। মূল উদ্দেশ্য সংগীতের সব শাখার মানুষকে একত্র করা, সংকটে পাশে থাকা।’ বন্যা আরও বলেন, ‘করোনার সময় আমরা অনুভব করেছি যে শিল্পীরা আসলে প্রত্যেকে আলাদা একটা দ্বীপের মতো বাস করে। তার নিজের জগতে সে নিজেই একা। কিন্তু সে যখন বড় একটা সংকট বা সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন কিন্তু একা একা মোকাবিলা করা খুব কঠিন। কখনো কখনো অসম্ভব। করোনার সময় দেখেছি, দূরদূরান্তের শিল্পীদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। তারা যোগাযোগ করে, কষ্টের কথা জানায়। তারা যে নীরবে নিভৃতে সাধনা করে যাচ্ছে, কষ্টে আছে—তাদের আমরা খবর রাখি না। কোথাও তাদের মুখপাত্র নেই, দুঃখের, সংকটের সমস্যার কথা শোনার কেউ নেই। আমাদের এই প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য সংগীত–সম্পর্কিত মানুষগুলোকে একত্র করাও। শিল্পীদের যেকোনো অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করা।’

নিজেদের অবস্থান এবং উদ্দেশ্য জানানোর লক্ষ্যে সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের আয়োজনে মাসব্যাপী প্রথম জাতীয় উৎসব ও সম্মেলনে গাইছে ব্যান্ড দুরবীন
ছবি : সংগৃহীত

সংগীত ঐক্যের মহাসচিব শহীদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন, সংগীতের বিভিন্ন শাখায় কাজ করছেন এমন সব মানুষকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসতে পেরেছি। এবারই প্রথম একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গীতিকবি, কণ্ঠশিল্পী, সুরকারদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কপিরাইট আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার জন্য আমাদের সদস্য সংগঠনগুলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে সংশোধিত কপিরাইট আইন এখন পার্লামেন্টে পাসের অপেক্ষায়।’ তিনি জানান, এ অনুষ্ঠানের আগে আগে যন্ত্রশিল্পীদের সংগঠন বিএমএফ-কে সংগীত ঐক্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সংগীত ও সংগীত–সংশ্লিষ্টদের স্বার্থে ১৮ দফা প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এসবের মধ্যে অন্যতম প্রস্তাব, সংগীতের উন্নয়নের জন্য সংগীত একাডেমি গঠন, শিল্পীদের কপিরাইট নিশ্চিতকরণ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব দাবি তোলা হয়েছে, সবই যৌক্তিক
ছবি : প্রথম আলো

প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাস

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব দাবি তোলা হয়েছে, সবই যৌক্তিক। এসব দাবি নিয়ে আট–নয় মাস আগে থেকে আমরা আলোচনা করছি। সংগীতশিল্পীদের হাজার হাজার গান বাজছে, কিন্তু তাঁরা রয়্যালটি পান না। এটি নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পীদের সৃষ্টি, অর্জন এটা অন্য কেউ ভোগ করবে, তা হতে পারে না। কপিরাইট বিষয়ে আমরা খুব সিরিয়াস। সংগীত একাডেমি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সংগীতের সব সংগঠনের অফিস বরাদ্দের ব্যবস্থা করছি। সংগীতের মানুষদের সরকারি হাসপাতালে বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিষয়ে ভেবেছি। আমরা মনে করি, চিকিৎসা তো অধিকার, এটা চেয়ে নিতে হবে কেন। সংগীতের জন্য জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতির বিষয়টিও আমরা ভাবছি।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতে মঞ্চে আসেন চট্টগ্রামেরই সন্তান সংগীতশিল্পী সমরজিৎ রায়। ভারতের দিল্লির গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে ১২ বছর উচ্চাঙ্গসংগীতের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন এই শিল্পী। তিনি পরিবেশন করেন রাগ ভৈরবীতে একটি ঠুমরি। এরপর মঞ্চে আসেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগীত ভবনের শিল্পীরা। ১৯৬৬ সালে প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্ত ও বনবীথি সেনগুপ্তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগীত ভবন। প্রতিষ্ঠানটি শাস্ত্রীয়সহ সংগীতের নানান ক্ষেত্রে তৈরি করেছে অসংখ্য গুণী শিল্পী। এ প্রতিষ্ঠানের শিল্পীরা একে একে শোনালেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনী কান্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের গান।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান পরিবেশন করেন নিলীমা বিশ্বাস ও প্রেম সুন্দর বৈষ্ণব
ছবি : প্রথম আলো

সন্ধ্যার পর গান শোনাতে মঞ্চে ওঠেন প্রেম সুন্দর বৈষ্ণব। অনেক জনপ্রিয় ও কালজয়ী আঞ্চলিক গানের শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের ছোট ছেলে শিল্পী প্রেম সুন্দর বৈষ্ণব সহশিল্পী নিলীমা বিশ্বাসকে নিয়ে ‘বাইক্কা ট্যায়া দ’, ‘বানুরে ও বানু’সহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন। এরপর ছিল রাঙামাটির পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ব্যতিক্রম পরিবেশনা। ব্যান্ড দূরবীন আনল বৈচিত্র্য, দলনেতা সৈয়দ শহীদের নেতৃত্বে আইয়ু্ব, কাজী শুভরা মিলে শোনান জনপ্রিয় ‘স্বপ্ন ডানায়’, ‘লুসাই পাহাড়’, ‘আমি যারে ভালোবাসি’, ‘সোনা বউ’ এবং ‘বাংলাদেশ’।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল ঢাকা থেকে আসা তারকা শিল্পীদের গান। মঞ্চে আসেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, কুমার বিশ্বজিৎ, হাসান আবিদুর রেজা, জয় শাহরিয়ার, কিশোর প্রমুখ। গান শোনায় রেনেসাঁ, দলছুট, সোলস ব্যান্ডও। রাত নয়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলছিল। বাইরে তখনো বৃষ্টির ধারাপাত। ভেতরে মিলনায়তনভর্তি মানুষ। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বের সঞ্চালনা করেন সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সচিব হাসান আবিদুর রেজা। দ্বিতীয় পর্বের সঞ্চালনা করেন গীতিকবি কবির বকুল।

মাসব্যাপী আয়োজন

২৪ জুন সিলেটের কবি নজরুল মিলনায়তনে এবং আগামী ১ জুলাই বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীতের জাতীয় উৎসব হবে। মূল অনুষ্ঠান হবে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, ১৬ জুলাই।