জাতীয় কবি সবার হৃদয়ে জাগ্রত, অথচ নথিপত্রে নেই

যুবক নজরুলের পটে শিল্পী ফেরদৌস আরাকোলাজ
আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। সারা দেশে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটি পালিত হবে সীমিত পরিসরে, থাকবে অনলাইনভিত্তিক নানা আয়োজন। রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত কবির সমাধি ছেয়ে যাবে ফুলে ফুলে। নজরুল স্মরণে আজ রাতে চ্যানেল আইয়ে দেখানো হবে নজরুলসংগীতের বিশেষ অনুষ্ঠান ‘সোনার হিন্দোল’। এ অনুষ্ঠানে গাইবেন সংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরা। নানা প্রসঙ্গে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।

প্রশ্ন :

‘সোনার হিন্দোল’ ছাড়া আজ আর কোন আয়োজনে আপনাকে পাওয়া যাবে?

চ্যানেল আইয়ের ‘সোনার হিন্দোল’ ছাড়া এশিয়ান টেলিভিশনের জন্য চারটা গান করেছি। ভারতের কালারস বাংলা টেলিভিশনের জন্য দুটি গান গেয়েছি। নজরুলসংগীতের এক কণ্ঠে হাজার গান, ইমপ্রেস অডিও ভিশনের ১০ নম্বর খণ্ডের কাজও শেষ করেছি। সেখান থেকে কিছু অপ্রচলিত গান নিয়ে ‘সোনার হিন্দোল’ অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন :

নজরুলসংগীতের শিল্পী হিসেবে বিষয়টা কীভাবে দেখেন?

আমরা সবাই মুখে মুখে জাতীয় কবি বলছি। অনেকে এ বিষয়ে উদারচিত্ত দেখান; বলেন, জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই কী, না দিলেই কী! আমরা তো সবাই জানি, তিনি আমাদের জাতীয় কবি। আমরা সবাই জানি ঠিক আছে, কিছু বিষয় রাষ্ট্রীয়ভাবে লিখিত হতে হয়। সেই জায়গা থেকে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের ব্যাপারে উদাসীন। এটা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। জাতীয় কবি সবার হৃদয়ে জাগ্রত, অথচ নথিপত্রে নেই!

নিজ বাড়িতে রেয়াজ করছেন ফেরদৌস আরা
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

জাতীয় কবির স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা কোথায়?

আমার ধারণা, কূটনৈতিক জটিলতা কিছু আছে হয়তো। যা-ই থাকুক, আমার শুধু এটুকু চাওয়া, একজন শিল্পী শিল্পী হিসেবে এটা আমাদের সবার চাওয়া, রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা হোক।

প্রশ্ন :

তরুণদের নজরুলসংগীতের চর্চা নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

আমাকে যখনই জিজ্ঞেস করা হয়, আমি বলি, তরুণদের মধ্যে নজরুলসংগীতের প্রচুর চর্চা হচ্ছে। আমার চোখে তা দেখতে পাই। এই করোনায়ও ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের এমনকি দেশের বাইরে থেকে নজরুলসংগীতে আগ্রহী অনেকে অনলাইনে যোগাযোগ করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ঢাকা শহরের বাইরেও অনেকের মধ্যে নজরুলের গান করার আগ্রহ আছে। এদের লালন না করলে একটা সময় আগ্রহ মরে যাবে।

ফেরদৌস আরা
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরুলসংগীতের চর্চা কতটা পৃষ্ঠপোষকতা পায়?

নানা রকম চেষ্টা চলছে এবং হয়ও, কিন্তু তার গতি শ্লথ। আমাদের ড. রফিকুল ইসলাম স্যার আছেন, তিনি অনেক কাজ করছেন। তবে আরও গতিশীল হওয়া দরকার।
বাবার সঙ্গে ঢাকার ধানমন্ডিতে কবি ভবনে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

প্রশ্ন :

তাঁকে গানও শুনিয়েছেন। সেই সময়কার স্মৃতি মনে পড়ে?

কবিকে যখন দেখতে গিয়েছিলাম, তিনি নির্বাক ছিলেন। আমার তখন কিশোরীকাল। ধানমন্ডির কবি ভবনে আমরা গেলাম, দোতলায়। বাবা আমাকে কবিকে গান শোনাতে বললেন। হঠাৎ মনের মধ্যে সায় দিল, তাঁকে গান শুনিয়ে লাভ কী? তিনি তো কিছু বুঝবেন টুজবেন না। যা-ই হোক, ‘নীলাম্বরি শাড়ি পরি নীল যমুনায়’, গানটি গাইবার একপর্যায়ে খেয়াল করলাম, নির্বাক কবি উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে বসে গেছেন। মুখটা খুব নড়াচড়া করছিল, কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু পারছিলেন না। বুঝলাম, তিনি আন্দোলিত হচ্ছেন, একটা সময় কবি, বাহ্‌ বলে উঠলেন!

ফেরদৌস আরা
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

এখন যেহেতু কবিকে পাওয়া সম্ভব না, কল্পনায় কবিকে পেলে যে গানটি শোনাতে চান কিংবা যে কথাটি বলতে চান?

ওই কথাটি, কবি সবার কথা কইতেন, এবার নিজের কথা কহো। কিংবা আমরা বলব, মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ। অথবা বলব, সে চলে গেলে বলে কি কভু, স্মৃতিও তার যায় ভোলা। এই কথা তো কবি নিজেই লিখে গেছেন। বলেছেন, ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি। কবি নিজেই এতসব বাণী রেখে গেছেন আমাদের জন্য, আবার বলেও গেছেন, আমরা না থাকলে কী কী হবে।

প্রশ্ন :

এ প্রজন্মের নজরুলসংগীতের চর্চা যাঁরা করেন, কাদের সম্ভাবনাময় মনে হয়?

সম্ভাবনাময় কিন্তু অনেকে আছে। আমি সম্ভাবনা এভাবেই দেখি, কণ্ঠ সুন্দর, প্রক্ষেপণ সুন্দর, উপস্থাপন সুন্দর। এই যে সুন্দরভাবে যারা নজরুলসংগীত গাইছে, তারা একটা সময় আধুনিক গানের দিকে ছুটছে। হয়তোবা সিনেমার গান, স্টেজ শোতে বেশি ডাক পাবে, তাই ওদিকটায় ছুটছে। অথচ অনেক ধরনের প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও আমরা নজরুলসংগীত আঁকড়ে ধরেছিলাম। আছি, থাকব। এই ডিভোশনটা থাকতে হবে। আমি নজরুলসংগীত গাই, নজরুলসংগীতই গাইব—এমন মানসিকতা থাকতে হবে। আবার যারা মেধাবী ও সম্ভাবনাময়, তাদের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ডেকে এনে অনুষ্ঠান দেওয়া উচিত। প্রচারের আলোয় রাখা উচিত, উৎসাহ দেওয়া উচিত। অনুপ্রাণিত করা উচিত। তাই বলছি, অনেকে আছে, কয়েকজনের নাম বললে আরও অনেকের নাম বাদ যাবে।

প্রশ্ন :

বর্তমান প্রজন্মে যাঁরা আধুনিক গান গাইছেন, তাঁদের মধ্যে কাউকে দিয়ে নজরুল সংগীত গাওয়াতে চান?

খুদে গানরাজ, সেরাকণ্ঠ চ্যাম্পিয়নসহ অন্যান্য রিয়ালিটি শো থেকে চ্যাম্পিয়ন যারা আছে, তাদের সবাইকে একসঙ্গে করা হোক। এরা সবাই অসম্ভব মেধাবী। আধুনিক গান যারা ভালো গায়, তাদের অনেকে নজরুলসংগীতও বেশ ভালো গায়। আগের দিকে তাকালে দেখব, কনকচাঁপা, শাম্মী আখতার এমনকি সাবিনা আপা—এঁদের সবারই নজরুলসংগীত থেকে শুরু। সুবীর নন্দী সব সময় বলতেন, তিনি নজরুলসংগীতের শিল্পী। নতুনদের মধ্যে যদি বলতে হয়, সেরাকণ্ঠ চ্যাম্পিয়ন কোনালের কথা অবশ্যই বলতেই হয়, সেও আধুনিকের পাশাপাশি নজরুলসংগীতও ভালো গায়। এ ছাড়া সুমনা, ঐশীর কথাও বলতে চাই।

প্রশ্ন :

আধুনিক গানের কোনো শিল্পীর সঙ্গে যদি কেউ আপনাকে দ্বৈত গানের শিল্পী হিসেবে দেখতে চান, সেই শিল্পী কে এবং কেন?

গান এমন একটা বিষয়, গাইতে বয়স লাগে না। আমাদের দেশে এমন একটা কণ্ঠ ছিলেন, যিনি ৭২ বছর বয়সেও তিনি অসাধারণ গাইতেন, নাম তাঁর আবদুল হালীম চৌধুরী। এত সুন্দর গলা ছিল, এখনো সন্ধ্যায় টেলিভিশনে তাঁর গান বাজে, ‌‘‌দে পানা দে, ইয়া এলাহী’। এই গানের শিল্পীর মূল্যায়ন কোনো দিন হয়নি। এখন যারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে এসেছে, তারা ভীষণ ভালো গায়। তাই আমার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠের আধুনিক গানের জন্য তরুণদের কথাও বলব। আর আজীবন সুন্দর গেয়েছেন আমাদের হাদী ভাই (সৈয়দ আব্দুল হাদী) ও রফিকুল আলম ভাই। তাঁদের সঙ্গে গাইতে পারাটাও আনন্দের হবে।