জানালা বারান্দা ও ছাদের গান

চিরকুট ব্যান্ডের সদস্যরা। ছবি: আনন্দ
চিরকুট ব্যান্ডের সদস্যরা। ছবি: আনন্দ

ঘরের প্রিয় জায়গা কোনটি? অনেকেই বলবেন, জানালা। জানালায় বসে গুনগুন করে গান করেন না এমন মানুষ কমই আছে। কিন্তু কে দেখে, কে শোনে সেই গান! যে গায়, তার মন হালকা হয়ে যায়, সে তো সবারই জানা। জানালায় বসে প্রিয় একটা গান করলে মন হালকা লাগে। সেই চেষ্টা করেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থী আহনাফ সায়েম। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে’ গানটি গেয়েছেন তিনি।

ঢাকার উত্তরার আসেফ গেয়েছেন রাফার ‘আমি আকাশ পাঠাব’। তাঁদের গানের ভিডিও দেখেই অনেকের মন হালকা হয়েছে। ঘরবন্দী করোনাকালে মন হালকা করার এ প্রয়াসের নাম আলোর গান।

করোনায় সবাই যখন ঘরবন্দী, তখন এ আয়োজন শুরু করেছিল গানের দল চিরকুট। জানালা, বারান্দা ও ছাদে বসে যেকোনো বয়সী মানুষের গাওয়া, যেকোনো গানের ভিডিও তারা প্রকাশ করছে নিজেদের ফেসবুক পেজে। করোনা মহামারিতে ঘরে আটকে থাকা মানুষদের কিছুটা প্রশান্তি দিতে এ উদ্যোগ। শুরুতে সুমীর কথা ও সুরে তাসফি, নিবিড়, রিফাত, প্রান্ত, মিথিলা, ব্যান্ডদল ক্রিপটিক ফেইটের শাকিব চৌধুরী ও চিরকুটের ভোকাল সুমী মিলে গেয়েছেন আলোর গান। এরপর আলোর গান পৌঁছে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে—শহর, মফস্বল, ভিনদেশ, অজপাড়াগাঁ, পাহাড় ও সমুদ্রে।

কেন আলোর গান?

আলোর গান গেয়ে পাঠাচ্ছেন নানা রকম মানুষ। একেকটা গানের সঙ্গে উঠে আসছে অনেক অনেক গল্প। গেয়েছেন বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে। বিস্ময়করভাবে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষও গান গেয়ে পাঠিয়েছেন। আলোর গান গেয়েছেন সেনা কর্মকর্তা, ব্যাংকার, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাজীবীরা। চিরকুটের ফেসবুক পেজে সেসব গানের ভিডিও দেখা যাচ্ছে। আলোর গানের থিম সংয়ে আলোর কাছে প্রার্থনা করেছেন শিল্পীরা। আলো যেন মানুষের সব কষ্ট সারিয়ে দেয়, ক্ষত মুছে দেয়। সুমী বললেন, ‘ঘরবন্দী মানুষের আলোর উৎস জানালা, বারান্দা ও ছাদ। এসব জায়গায় দাঁড়ালে আমরা একটু প্রশান্তি পাই। মানুষের প্রশান্তি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমরা এ আয়োজন করেছি। অভাবনীয় সাড়াও পাচ্ছি।’

করোনাকালের এই দুঃসময় কেটে না যাওয়া পর্যন্ত আলোর গান পাঠানো যাবে চিরকুটের [email protected] এই ঠিকানায়, নাম-ঠিকানাসহ। ভিডিও রেকর্ড করতে হবে ছাদ, বারান্দা বা জানালার আলোয়।

আলোর গান নিয়ে বাড়তি কিছু আশা আছে চিরকুটের। কেবল প্রশান্তি বিনিময়ের এ উদ্যোগ হয়ে উঠতে পারে করোনাদুর্গতদের সাহায্য তহবিল সংগ্রহের পথ। সংগৃহীত গানগুলো একযোগে প্রকাশ করা হচ্ছে চিরকুটের ফেসবুক পেজে। এ উদ্যোগের সঙ্গে আরও রয়েছে এটুআই, গান বাংলা, প্রথম আলো ডটকম ও সল্ট ক্রিয়েটিভস।

কিছু আলোর গানের গল্প

শুরুতে বলা হয়েছিল, আলোর গান এসেছে পাহাড় থেকে, সমুদ্র থেকেও। সমুদ্র থেকে আসা আলোর গান নিয়ে কিছু বলা যাক। এ মারুফ সুদূর পারস্য উপসাগর থেকে গেয়ে পাঠিয়েছেন ‘প্রেমে পড়া বারণ’ গানটি। নিজের ঘরের জানালা বা বারান্দা থেকে নয়, নাবিক মারুফ গানটি গেয়েছেন জাহাজের কেবিনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। দেশ, ভাষা ও কাছের মানুষদের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকলেও, আলোর গান তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে লক্ষাধিক শ্রোতার কাছে।

এবার আসি পাহাড়ের বুক থেকে আসা আলোর গানে। নীলা চাকমার কণ্ঠে গাওয়া চিরকুটের ‘আহারে জীবন’ গানটি এসেছে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই থেকে। চুলে বুনো ফুল গুঁজে মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে আলোর গানটি গেয়েছেন তিনি।

এ ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া ফেলেছে খুলনার মমরোজ ও সাতক্ষীরার অনুরাধা মন্ডলের গান। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আলোর গান আসার পাশাপাশি এই উদ্যোগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও ভীষণ সাড়া ফেলেছে। প্রমাণ পাওয়া গেল চিরকুটের ফেসবুক পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে। গান এসেছে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক, অভিবাসী এমনকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরাও অংশ নিয়েছেন এই আয়োজনে, গেয়েছেন আলোর গান। যেমন সৌদি আরব থেকে একজন প্রবাসী পাঠিয়েছেন তাঁর আলোর গান। এই গান ও গানের শিল্পীর ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। তিনি শুধু গানটি পাঠিয়ে আলোর গানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আয়োজকদের কাছে। বাংলা ভাষাভাষীদের বাইরেও ছড়িয়ে গেছে আলোর গান। উপমহাদেশের কিংবদন্তী বেহালাবাদক ও সংগীতজ্ঞ এল সুব্রামানিয়াম ও ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী কবিতা কৃষ্ণমূর্তির দুই সন্তান বিন্দু ও আম্বি সুব্রামানিয়াম, নরওয়ের শিল্পী সুলভাই কোরামও গান গেয়ে অংশ হয়েছেন এই কার্যক্রমের। এভাবেই নাম জানা ও না জানা অনেকের গান এসে রোজ জমা হচ্ছে চিরকুটের ভার্চ্যুয়াল ডাকবাক্সে। আর প্রতিটি ঘরের ভেতরে থাকা গল্পগুলো আলোর দেখা পেয়ে বারান্দা-জানালার ফাঁক গলে পৌঁছে যাচ্ছে লাখো-কোটি শ্রোতার কাছে।