তবে কি তাঁর আশঙ্কাই ঠিক?

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: প্রথম আলো

‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘একাত্তরের মা জননী, কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকব’—গানগুলোর সৃষ্টির সঙ্গে যে মানুষের নাম জড়িত, তিনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। দেশের গানে তিনি অনন্য এক নাম। বুলবুলের তৈরি গান যাঁরা গেয়েছিলেন, তাঁদের হয়তো আজকের দিনটার কথা মনে নেই। জীবদ্দশায় সেই আশঙ্কায় একটি স্থিরচিত্র ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেনও তিনি। তাঁর মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় সেটিই সত্য হয়েছে। তবে কি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে ভুলতে বসেছে দেশের সংগীতাঙ্গন!

ফেসবুকে শেষবার এই ছবি শেয়ার করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: ফেসবুক থেকে

পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমানো বরেণ্য শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের আজ জন্মদিন। আর মাত্র ২১ দিন পর তাঁর মৃত্যুর ৩ বছর পূর্ণ হবে। মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে সামাজিক ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করে নিজেকে ভক্ত-শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন বরেণ্য শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে বসে নিজের তোলা ছবিটি পোস্ট করেন। ছবির ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও…তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’ ছবিটি পোস্ট করার পরই ফেসবুক বন্ধু ও ভক্তরা তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানালেও আজকের দিনে ফেসবুক ঘেঁটে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখা যায়নি। হয়নি সংগীত সংগঠন বা শিল্পকলা একাডেমির উল্লেখযোগ্য কোনো আয়োজন। এমনকি সেদিন বুলবুলের মৃত্যুর পর যাঁরা টেলিভিশনের সামনে তাঁকে নিয়ে নানা কথা বলেছিলেন, তাঁদেরও কোনো আয়োজনে দেখা যায়নি।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ওয়াফিজ আহমেদ ও মা ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট উচ্চবিদ্যালয়ে তিনি মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং শিক্ষাজীবনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুলে থাকা অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন।

জীবনকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। তখন আমার বয়স সাড়ে ১৪ বছর। আগরতলায় আমরা প্রশিক্ষণ নিই। মনে পড়ে, আমরা চারজন একসঙ্গে রেকি করতাম—মানিক, মাহবুব, খোকা আর আমি। কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কে পাকিস্তানি হানাদাররা কতগুলো দুর্গ করেছে, সেগুলো দেখে আসতাম। একসময় পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলাম, ওরা আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিয়মিত গান করেন। প্রথমে শুধু দেশের গানই করতেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন গিটারবাদক ছিলাম। যুদ্ধের দিনের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই রোমহর্ষক দিনগুলোর স্মৃতি, হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। যাঁদের হারিয়েছি, অনুভব করলাম, তাঁদের জন্য কিছু করা দরকার। সেই থেকে টানা আট বছর আমি শুধু দেশের গান করেছি। অন্য গান করিনি।’
১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ১৯৮৪ সালে বেলাল আহমেদের পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রের গীত রচনা ও সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। সেই চলচ্চিত্রের তাঁর লেখা ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকব’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।

বুলবুল স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। তিনি সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, জেমস, আগুন, কনকচাঁপা, মনির খানসহ বাংলাদেশি প্রায় সব জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীকে নিয়ে কাজ করেছেন। সংগীত প্রতিভা অন্বেষণে বাংলাদেশের রিয়েলিটি অনুষ্ঠান ক্লোজআপ ওয়ানের তিন মৌসুমে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই বরেণ্য শিল্পী।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

তিন শতাধিক সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেছেন। দুবার বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথমটি ‘প্রেমের তাজমহল’ ও দ্বিতীয়টি ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য। ২০১৮ সালের ১৬ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অসুস্থতার খবর দেন বুলবুল। সেদিন তিনি লিখেছেন, ‘একটি ঘরে ছয় বছর গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমি আজ উল্লেখযোগ্যভাবে অসুস্থ। আমার হার্টে আটটা ব্লক ধরা পড়েছে। এরই মাঝে কাউকে না জানিয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে সিসিইউতে চার দিন ছিলাম। আগামী ১০ দিনের মধ্যে হার্টের বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য প্রস্তুত আছি।’ চিকিৎসা চলছিল। পরে অবশ্য বাইপাস নয়, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হৃদ্‌যন্ত্রে দুটি স্টেন্ট পরানো হয়। তারপর সবকিছু ব্যর্থ করে ৬৩ বছর বয়সে ঢাকার আফতাবনগরে তাঁর নিজ বাসায় হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হঠাৎ চলে যাওয়ায় আক্ষেপ চিরদিন থেকে যাবে অনুরাগীদের মাঝে। কিন্তু তাঁর সুর দেওয়া বহু গান টিকে থাকবে অনেক দিন। সেগুলোর মধ্য থেকে যাবে অকালে চলে যাওয়া বরেণ্য এই গানস্রষ্টার নাম।