দুঃখ-টুঃখ পেলে বাজিয়ে শুয়ে থাকা গানগুলো

প্রয়াত শিল্পীকে ঘটা করে স্মরণ করা হয় বছরে দু’বার। একবার জন্মবার্ষিকীতে, আরেকবার মৃত্যুবার্ষিকীতে। সাধারণ মানুষের জন্মদিনে আনন্দ আর মৃত্যুবার্ষিকীতে শোক পালনের রীতি। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন নয়। ধরা যাক, সঞ্জীব চৌধুরীর বেলায়। তাঁর জন্মদিনেও তাঁর গান গাওয়া হয়, মৃত্যুদিনেও গান করা হয়। আর এও অবধারিত যে, খুব কাছের দু’একজন মানুষ হয়তো ‘চোখটা এত পোড়ায় কেন, ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও’ গাইতে গাইতে বা শুনতে শুনতে একপর্যায়ে হুহু করে কেঁদে ফেলবেন। এটা যে শুধু তাঁর মৃত্যুদিনেই হবে তা নয়, আজ তাঁর জন্মদিনেও হবে।
সঞ্জীবের গানের ভক্তদের একটা ‘কমন’ বেদনা আছে। ২০০০ সালের পড় থেকে ছেলেদের প্রেমে পড়া, দুঃখ পাওয়ার ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরীর গান মিশে আছে। কলেজের গেট থেকে রিকশায় করে চলে যাওয়া মেয়েটার জন্য মনের ভেতর একটু ‘কেমন-কেমন’ করেছে যার, তাঁর জন্য সঞ্জীব গেয়েছেন ‘রিকশা কেন আস্তে চলে না’ গানটা।
প্রেমিকার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সময় কাটানো নস্টালজিয়া উসকে দিতে তিনি গেয়েছেন ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেইখাছিলাম বায়োস্কোপ’ গানটি। আর যে তরুণ জীবনে একবার অন্তত প্রেমে পড়েছে, কিংবা বারবার, তার জন্য ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’ গানটি। এইরকম আরও বেশ কিছু গানের কারণে তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে সঞ্জীবের জন্য একটা ভালোবাসার আসন পাতা থাকে।
বাংলা গানের ভান্ডার আলী বাবার চুরি করা রত্ন ভান্ডারের থেকেও বিশাল। সেখানে ষাট, সত্তর, আশির দশকের কিছু গান যখন ঘুরে ফিরে শুনতে হচ্ছিল, ঠিক তখনকার কথা। সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী তখন হঠাৎ করেই তরুণদের মনোযোগ কেড়ে নিলেন। একেবারে অন্যরকম কণ্ঠে ‘আমি তোমাকে বলে দেব, কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরাণ পথে’ গান গেয়ে হাহাকার ছড়িয়ে দিলেন সবার হৃদয়ে। দুঃখ-টুঃখ পেলে বাজিয়ে শুয়ে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি নতুন গান তিনি তুলে দিলেন তরুণদের হাতে। ব্যান্ডের গানের একটা সিলেবাস তত দিনে তৈরি হয়ে আছে। সেই সিলেবাসে তিনি যোগ করলেন বাউল ও লোকধারার কয়েকটি গান। যদিও বাউলগান ব্যান্ডশিল্পীদের কণ্ঠে, অ্যালবামে ঠাঁই পেতে শুরু করেছিল আশির দশকের পর থেকেই। কিন্তু সঞ্জীবের ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইসে’ গানগুলো নতুন করে তরুণদের প্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নিতে শুরু করে। তিনি হয়ে উঠতে থাকেন তরুণদের প্রিয়জন।
সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৬৪ সালের আজকের দিনে জন্মেছিলেন হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি ‘দুঃখ চেপে’ চলে যান না ফেরার দেশে। বেঁচে থাকলে আজ ঘটা করে টিএসসিতে পালন করা হতো তাঁর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব। সেটা আজও পালন করা হবে হয়তো, শুধু সশরীরে সঞ্জীব থাকবেন না, তাঁর কণ্ঠ শুনব আমরা।
গান করা দুই তরুণের গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। প্রতি সন্ধ্যায় দুই বন্ধু গিটার নিয়ে বসতেন। নিজেদের নির্ধারিত গান শুরুর আগে তারা শুনতেন সঞ্জীবের গান। গানের লিরিক, সুর, গায়কি নিয়ে তাঁদের কত যে বিশ্লেষণ, সেসব বলে শেষ করা যাবে না। আশপাশের সবাই বিরক্ত হয়ে যেত। একজন সাদামাটা গায়ককে নিয়ে এত আহ্লাদিত হওয়ার কী আছে তাঁরা বুঝে উঠতে পারতেন না। সঞ্জীব যেদিন মারা গেলেন, সেদিন থেকে আজ অবধি তারা আর গিটার নিয়ে বসেননি। কেন কে জানে! গল্পটা মফস্বলের এক ছোট্ট শহরের দুই তরুণের।