নজরুল: ছিলেন অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালকও

প্রতিভার এই বরপুত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিলেন আজীবন গভীর নিমগ্ন এক স্রষ্টাকোলাজ

‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’, এই বিস্ময়কর দ্বৈতসত্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং মানবতায় হৃদয়সংবেদী প্রেমিক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বহু গুণের এ মানুষ গান, কবিতা, গল্প, নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। যেখানে তিনি একাধারে গীতিকার, সংগীত পরিচালক, কাহিনিকার, সুরকার ও নির্মাতা হয়ে কাজ করেছেন। অভিনয় করেছেন দাপটের সঙ্গে।
নজরুল স্বভাবে ছিলেন আজীবন অস্থির, চঞ্চল। কিন্তু প্রতিভার এই বরপুত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিলেন আজীবন গভীর নিমগ্ন এক স্রষ্টা। অস্থিরতা তাঁর বৈচিত্র্য ভাবনার সহচর। ব্যক্তিজীবনে নিরন্তর অবস্থান ক্ষেত্রে পরিবর্তন সেই অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যের পরিচয় বহন করে। নির্দিষ্ট বিষয়ে থেমে থাকেননি তিনি। তাই শুধুই অভিনয় আর পরিচালনা নয়, রীতিমতো প্রশিক্ষকের কাজ করতেন নজরুল। সহশিল্পীদের অভিনয় শেখাতেন, গান তুলে দিতেন শিল্পীদের। এমনকি উচ্চারণও ঠিক করে দিতেন। ত্রিশের দশকে নজরুল পার্সি মালিকানাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটার্সের ‘সুর ভাঙারি’ পদে নিযুক্ত হন। এই পদটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন নজরুল।

অভিনেতা নজরুল
সেই সময়ের নামকরা প্রযোজক পিরোজ ম্যাডান ১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। পুরাণের কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। নজরুল এ ছবির গান লেখেন এবং সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয় করেন এবং একটি গানে কণ্ঠ দেন।

চলচ্চিত্রে অভিনেতা নজরুল
ছবি: সংগৃহীত

১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি ‘ধ্রুব’ মুক্তি পায়। ওই চলচ্চিত্রে নিজেকে একেবারে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। যেমন স্বর্গের সংবাদবাহক এবং দেবর্ষি নারদের চরিত্রে সব সময় দেখা যায় জটাধারী, দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ একজনের চেহারা। কিন্তু নারদ নজরুল ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। তাঁর নারদ এক সুদর্শন যুবক। হাসি হাসি মুখ। চুড়ো করে মালা বাঁধা ঝাঁকড়া চুল, ক্লিন শেভড। পরনে সিল্কের লম্বা কুর্তা, গলায় মালা। চলচ্চিত্রের পর্দায় এভাবেই নারদরূপে আবির্ভূত হলেন নজরুল। নারদ চরিত্রে নজরুলের সাজসজ্জা নিয়ে সে সময় পত্রিকায় সমালোচনা হয়েছিল যথেষ্ট। পাত্তা দেননি নজরুল। নজরুল তাঁর জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমি চিরতরুণ ও চিরসুন্দর নারদের রূপই দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ ম্যাডান থিয়েটার্স বিভিন্নভাবে নজরুলের প্রাপ্য সম্মানী নিয়ে প্রতারণা করায় ১৯৩৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন তিনি।

পরিচালক নজরুল
নজরুল নিজে পরিচালনা করেছেন ‘ধূপছায়া’ নামের একটি চলচ্চিত্র। ‘ধূপছায়া’তে দেবতা বিষ্ণুর চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৩১ সালে অমর চৌধুরী পরিচালিত সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাইষষ্ঠী’তে সুরকারের ভূমিকায় কাজ করেন নজরুল। ১৯৩১ সালের ১১ এপ্রিল জেএফ ম্যাডান কোম্পানির সবাক চিত্র ‘জামাইষষ্ঠী’ ক্রাউন সিনেমা হলে মুক্তি পায়। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন অমর চৌধুরী। একই বছর বাংলা সবাক চিত্র ‘জলসা’য় নজরুল নিজের একটি গান গেয়েছিলেন এবং ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।
কাহিনিকার ও সুরকার
১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’। এর কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। পরিচালক দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এ সিনেমা দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। বেদেজীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরুল বেশ কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন। ‘সাপুড়া’ নামে সিনেমাটির হিন্দি রিমেকও হয়েছিল। তার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল।

চলচ্চিত্রে নিজেকে একেবারে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। তিনি এবং পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এ ছবির গীতিকার। ‘পাতালপুরী’ সিনেমাটি কয়লাখনির শ্রমিক ও সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এ ছবির জন্য ‘ঝুমুর’ সুরে গান রচনা করেন নজরুল। তিনি কয়লাখনি অঞ্চল সম্পর্কে জানার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গৃহদাহ’ সিনেমার সুরকার ছিলেন নজরুল। এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় রহস্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গ্রহের ফের’। এ ছবির সংগীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন নজরুল।

১৯৩৭ সালের আলোচিত চলচ্চিত্র ‘বিদ্যাপতি’। কবি বিদ্যাপতির জীবনীভিত্তিক এ ছবির মূল গল্প ছিল নজরুলের। যদিও চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় ছিলেন দেবকী বসু। ছবিটির সুরকার ছিলেন নজরুল ও রাইচাঁদ বড়াল। মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির বিভিন্ন কবিতায় নজরুলের সুরদানের কাজ ছিল অসাধারণ। বাংলা ‘বিদ্যাপতি’র সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দিতে নির্মিত হয় ‘বিদ্যাপতি’। সে ছবিও ব্যবসাসফল হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘গোরা’।

সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল
ছবি: সংগৃহীত

ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। বিশ্বভারতী আপত্তি করে যে ছবিটিতে সঠিকভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হচ্ছে না। নজরুল তখন সোজা চলে যান কবিগুরুর কাছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে সমর্থন করেন এবং বিশ্বভারতীর সমালোচনা করে বলেন, ‘আমার গান কীভাবে গাইতে হবে, সেটা কি তোমার চেয়ে ওরা ভালো বুঝবে?’ তিনি নজরুলকে তাঁর গান নিজের খুশিমতো গাওয়ার ও ব্যবহারের অনুমতিপত্র দিয়ে দেন। নজরুল সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নিজের লেখা একটি গান এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ব্যবহার করেন। সে সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাল বাংলা’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্রের গানেও সুর করেছিলেন নজরুল। চলচ্চিত্রে কৌতুকময় একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি।

১৯৪২ সালে নির্মিত ‘চৌরঙ্গী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। পরে ‘চৌরঙ্গী’ হিন্দিতে নির্মিত হলে সে ছবির জন্য সাতটি হিন্দি গান লেখেন নজরুল। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিলরুবা’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল।

১৯৪১-৪২ সালে ‘মদিনা’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। এ সিনেমার জন্য তিনি ১৫টি গান লেখেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিনেমাটি আর মুক্তি পায়নি।

শেষ বয়সে নজরুল
ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র ব্যবসায় নজরুল
চলচ্চিত্র ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছিলেন নজরুল। ১৯৪১ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক প্রমুখ।

চলচ্চিত্রে নজরুল
১৯৭৬ সালে নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। তাঁর অসুস্থতার সময় এবং মৃত্যুর পর অনেক সিনেমায় তাঁর গান ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক জায়গায় তাঁর ও উত্তরাধিকারীদের অনুমতির তোয়াক্কাও করা হয়নি। তবে অধিকাংশ ছবিতেই নজরুলসংগীতের ব্যবহার দর্শকপ্রিয় হয়েছে।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমায় ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফেরে একা’ গানটি অত্যন্ত সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। একইভাবে ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির ব্যবহার ছিল অসাধারণ। ‘লায়লা-মজনু’ সিনেমায় ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোলো’ গানটির সার্থক ব্যবহার দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

নজরুলের ‘মেহের নেগার’ গল্প অবলম্বনে ২০০৬ সালে একটি সিনেমা নির্মিত হয়
ছবি: সংগৃহীত

নজরুলের ‘মেহের নেগার’ গল্প অবলম্বনে ২০০৬ সালে একটি সিনেমা নির্মিত হয়। সিনেমাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন মুশফিকুর রহমান ও মৌসুমী। চলচ্চিত্রে প্রধান দুই চরিত্র—কাশ্মীরের তরুণী মেহের নেগারের চরিত্রে মৌসুমী এবং আফগান যুবক ইউসুফের ভূমিকায় ফেরদৌস অভিনয় করেন। এ সময়ে আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় নজরুলের গল্প ‘রাক্ষসী’ অবলম্বনে। ‘রাক্ষুসী’ সিনেমার পরিচালক মতিন রহমান। তিনটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রোজিনা, পূর্ণিমা ও ফেরদৌস। এর আগে নজরুলের গল্প ‘জ্বিনের বাদশাহ’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন বাপ্পারাজ। নজরুলের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং গল্প ‘ব্যথার দান’ ও ‘পদ্মগোখরা’ অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাঁর দুটি কবিতা ‘লিচু–চোর’ এবং ‘খুকী ও কাঠবেরালি’ অবলম্বনে শিশুদের জন্য দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)