বৃষ্টি শেষে রুপালি কনসার্ট
আসনসংখ্যার বেশি দর্শক হাজির হবেন স্টেডিয়ামে। কিন্তু দিনের শুরু থেকেই ভাগ্যদেবী যেন মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। বৈরী আবহাওয়ায় দিনের শেষে আয়োজনও প্রায় ভেস্তে যাওয়ার অবস্থা। তখনই যেন ‘রোদ উঠে গেল’ রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার পর আয়োজক কোক স্টুডিও বাংলার পক্ষ থেকে ঘোষণা এল—কনসার্ট শুরু হবে রাত আটটায়।
রবিঠাকুরের ‘যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে’ আর শিরোনামহীনের ‘রোদ উঠে গেছে তোমাদের নগরীতে’ গানের এই লাইন দুটির ব্যবহার আছে কোক স্টুডিও বাংলার ম্যাশআপ ‘একলা চলো’তে। এর সঙ্গে ‘কনসার্ট হবে কি না’, সে নাটকীয়তারও কী দারুণ মিল!
আয়োজন শুরুর আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাত নয়টায় মঞ্চে উঠলেন ‘একলা চলো’ গানে কণ্ঠ দেওয়া শিল্পীরা। বগা তালেব গেয়ে উঠলেন গগন হরকরার গানের সেই লাইন, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে।’ এরপর অর্ণবের কণ্ঠে ‘যদি কেউ কথা না কয়’ আর শেষে শিল্পীদের সমস্বরে ‘রোদ উঠে গেছে তোমাদের নগরীতে, আলো এসে থেমে গেছে তোমাদের জানালায়...’।
মঞ্চ থেকে ফেলা লেজার রশ্মি গ্যালারি ছাপিয়ে গিয়ে পড়ছিল আশপাশের বাসাবাড়ির জানালাতেও। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কনসার্ট দেখছিলেন বাসিন্দারা। স্টেডিয়ামের গ্যালারি আর মাঠে তখন ঠাঁই ছিল না তিল ধারণের। বৃষ্টিতে কাদা জমে যাওয়া মাঠেও দর্শকেরা নেচে আর গলা মিলিয়ে আনন্দের যেন কোনো কমতি রাখলেন না। ফেসবুক লাইভেও দেশ-বিদেশ থেকে সে আনন্দে শামিল হন অগণিত শ্রোতা। প্রথম আলো ফেসবুক পেজ থেকেও প্রচারিত হয় এ কনসার্ট।
‘একলা চলো’ গানের পর একে একে পরিবেশিত হয় কোক স্টুডিও বাংলায় এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা গানগুলো। অনিমেষ রায় আর পান্থ কানাইয়ের ‘নাসেক নাসেক’-এর পর মঞ্চে আসেন মমতাজ ও মিজান। গান শুরুর আগে সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে পালন করা হয় এক মিনিট নীরবতা। এরপর ‘প্রার্থনা’ গানে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ গাইতেই গ্যালারিতে বসা কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল, ‘অনেক হয়েছে আর বৃষ্টি না হোক’।
প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলা আয়োজনে বৃষ্টি আর বাগড়া দেয়নি; বরং অর্ণব আর বগা তালেবের কণ্ঠে ‘চিলতে রোদে’ দর্শকের মধ্যে ছড়ায় আদুরে আবহ। কোক স্টুডিও বাংলায় প্রচারিত এই গানে গলা মেলাতে কেউ যেন বাদ গেলেন না। মনের মানুষের জন্য হৃদয়ে হাহাকার জাগানো গানটির পরই ‘ভবের পাগল’ নিয়ে হাজির হন সুমি ও জালালি সেট। আরও ছিল ঋতুরাজ-নন্দিতার গাওয়া ‘বুলবুলি’ ও ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে কোক স্টুডিও বাংলার ‘ভিন্নতার উৎসব’।
আয়োজকদের নিজস্ব প্রযোজনার বাইরে আমন্ত্রিত ব্যান্ডের পরিবেশনা যখন শুরু হয়, তখন দিনভর মেঘ জমে থাকা আকাশে দেখা মেলে চাঁদের। মঞ্চের জাঁকালো আলোকসজ্জা আর আকাশের চাঁদ দেখেই যেন তাহসান গাইলেন ‘চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না...।’
বিলম্বে শুরু হওয়ায় শেষ করারও তাড়া ছিল আয়োজকদের। তাই ব্যান্ডগুলোর জন্যও বরাদ্দ ছিল দু–তিনটি করে গান। তাহসানের পর ‘গণজোয়ার’ নিয়ে মঞ্চে আসে নেমেসিস। মূল ভোকাল জোহাদকে নিয়ে দর্শকের বিশেষ স্লোগান ছাপিয়ে সাড়া ফেলে ‘কবে’ গানটি। ‘ভবের পাগল’ নিয়ে আবার মঞ্চে আসে সুমির লালন।
রাত বেড়ে যাওয়ায় দর্শকদের কেউ কেউ তখন বাড়ির পথ ধরেছেন। ‘বসে আছি একা’ নিয়ে এসে ওয়ারফেজ তাদের পরিবেশনা শেষ করে ‘পূর্ণতা’ দিয়ে। সর্বশেষে মঞ্চে আসেন নগরবাউল জেমস। ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী তখন আরেকটা নতুন দিনের শুরু হয়ে গেছে। ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘পাগলা হাওয়া’, ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, ‘ভিগি ভিগি’র মতো জনপ্রিয় গানগুলোয় কণ্ঠ মেলান হাজার হাজার শ্রোতা। মধ্যরাতে এমন উদ্দীপনা দেখে মনে হয়েছে, এই কনসার্টে দীর্ঘদিন পর যেন তাঁরা পেয়ে গেলেন নতুন প্রাণের সঞ্জীবনী।