বেঁচে থাকলে হয়তো যুদ্ধের প্রতিবাদে বেজে উঠত তাঁর গিটার

জর্জ হ্যারিসন

জর্জ হ্যারিসন বিটলস ব্যান্ডের সবচেয়ে স্বল্পভাষী সদস্য বলে পরিচিত। ‘সরব’ ছিল তাঁর মোহনীয় আঙুলগুলো, যেগুলো খেলা করত গিটারের ছয় তার আর ফ্রেডবোর্ডজুড়ে। যে আঙুল লিখেছিল ‘ইফ আই নিডেড সামওয়ান’, ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস’, ‘উইদিন ইউ উইদাউট ইউ’-এর মতো গানগুলো। বিখ্যাত একটা ব্যান্ডের সদস্য ছাড়াও হ্যারিসনের একক পরিচয়, বদান্য, মাহাত্ম্য, কর্ম—কিছু কম নয়। আজ তাঁর ৭৯তম জন্মদিন।

জর্জ হ্যারিসনের কাছে বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্মরণার্থীদের সাহায্যে তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দুটি হাত। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলি চলছিল, ঠিক সেই সময়ে, ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বেজে উঠেছিল তাঁর গিটার। তিনি গেয়ে উঠেছিলেন ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ, সাচ আ ডিজাস্টার আই ডোন্ট আন্ডাস্ট্যান্ড, বাট ইট শোর লুকস লাইক আ মেস, আভ নেভার নোন সাচ ডিসট্রেস’। এই গান হয়তো অনেকে শোনেননি, কিন্তু ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা পৃথিবীর কে না শুনেছেন! বেঁচে থাকলে হয়তো আজও ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রতিবাদে বেজে উঠত তাঁর গিটার।

জর্জ হ্যারিসনের আজ ৭৯তম জন্মদিন

‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ দুটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়। মানুষের সাহায্যের জন্য কনসার্টের মাধ্যমে টাকা তোলা যায়, এ ছিল এক অভিনব ধারণা। সেদিনের কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও অংশ নিয়েছিলেন রবিশঙ্কর, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার প্রমুখ। কনসার্টের টিকিট, সিডি ও ডিভিডি বিক্রি করে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার বাংলাদেশের স্মরণার্থীদের জন্য পাঠিয়েছিলেন হ্যারিসনরা। সেসব এসে জমা হয় ইউনিসেফের তহবিলে।

জর্জ হ্যারিসন ১৯৪৩ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুলের একটি খেটে খাওয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বাবা শুরুতে ছিলেন একজন স্টুয়ার্ড, পরে বাসের কন্ডাক্টর। মা কাজ করতেন একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্লার্ক হিসেবে। মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকালে হ্যারিসন গিটার বাজাতে শুরু করেন। একদিন তাঁর দেখা হয় পল ম্যাকার্টনির সঙ্গে। ভালো বাজাতেন বলে পল তাঁকে কোয়ারিম্যান ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তখনো বিটলস হয়নি। পল ও জন লেনন মিলে গড়েছিলেন কোয়ারিম্যান। বেশ কয়েকবার ভাঙাগড়া আর লাইনআপ বদলের পর ব্যান্ডটার নাম হলো বিটলস আর দলের প্রধান গিটারিস্ট হিসেবে সামনে এলেন জর্জ হ্যারিসন। সেই দলে জন লেনন বাজাতেন রিদম গিটার আর গাইতেন গান। পলও গাইতেন, সঙ্গে বাজাতেন বেজ গিটার। রিঙ্গো স্টার ছিলেন দলের ড্রামার। এই নিয়ে বিটলস, পৃথিবী নাড়িয়ে দেওয়া রক ব্যান্ড।

চুপচাপ কাজ করে যাওয়া হ্যারিসনের ভারতীয় সংস্কৃতি ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ ছিল
ছবি: সংগৃহীত

লেনন ও পল লিখতেন আর গাইতেন দলের বেশির ভাগ গান। হ্যারিসনও লিখতেন। বিটলসের প্রতিটি অ্যালবামে তাঁর কোনো না কোনো গান থাকত। ১৯৬৩ সালে ‘ডোন্ট বদার মি’ দিয়ে হয়েছিল সেই সূচনা। পরে দেখা গেল, বিটলসের সেরা গানগুলোই হ্যারিসনের লেখা। সেগুলোর মধ্যে বলতে হয় ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস’, ‘হিয়ার কামস দ্য সান’, ‘সামথিং’ গানগুলোর কথা। চুপচাপ কাজ করে যাওয়া হ্যারিসনের ভারতীয় সংস্কৃতি ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ ছিল। ১৯৬৫ সালে পণ্ডিত রবিশঙ্করের কাছে সেতার শিখতে শুরু করেন তিনি। ‘নরওয়েজিয়ান উড’-এ সে বছরই সেই সাক্ষর রেখেছিলেন। চর্চাটা ধরেও রেখেছিলেন আমৃত্যু।

বিটলসের লিড গিটারিস্ট ছিলেন জর্জ হ্যারিসন
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

১৯৬৮ সালে হ্যারিসন প্রথম একক একটি গানের কাজ করেন ‘ওন্ডারওয়াল’ ছবিতে। ১৯৭০ সালে বিটলস থেকে বেরিয়ে একাই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সে বছর তাঁর একক অ্যালবাম ‘অল থিংস মাস্ট পাস’ ব্যাপক সমাদৃত হয়। ‘মাই সুইট লর্ড’ সেই অ্যালবামের ভীষণ জনপ্রিয় একটি গান।

১৯৬৭ সালে বিটলসের চার সদস্য, ডানে জর্জ হ্যারিসন

কণ্ঠনালি ও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। ১৯৯৭ সালে কণ্ঠনালির ক্যানসার ধরা পড়লে তাঁকে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয়েছিল, তিনি সেরে উঠবেন। ২০০১ সালে তাঁর ফুসফুস থেকে ক্যানসারের টিউমার অপসারণ করা হয়। ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর ৫৮ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যানসারেই মারা যান হ্যারিসন।