মা–বাবার পাশে শেষ ঘুমে মিতা হক

মিতা হক
ছবি: প্রথম আলো

স্বনামধন্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হকের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ রোববার জোহরের নামাজের পর কেরানীগঞ্জের বড় মনোহারিয়ায় জানাজা শেষে মা–বাবার কবরের পাশে শেষ ঘুমে যান তিনি। এর আগে বেলা ১১টায় তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সেখানে ফুল দিয়ে মিতা হককে শেষ শ্রদ্ধা জানান তাঁর সহকর্মী, স্বজন, শিক্ষার্থী ও গুণগ্রাহীরা। এ সময় সমস্বরে তাঁরা গেয়ে ওঠেন, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’, ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ ও ‘পথে চলে যেতে যেতে’ গানগুলো।
মিতা হক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন ছিলেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। করোনা থেকে সেরে উঠেছিলেন তিনি। চার দিন আগে করোনার নমুনা পরীক্ষা করিয়ে দেখা যায়, তিনি করোনামুক্ত। তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অসুস্থতা বোধ করলে তাঁকে আবার হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর ছিল নানা শারীরিক জটিলতা।

ছায়ানট ভবনের উঠানে লাশবাহী শীতল ভ্যানের ভেতরেই ছিলেন তিনি

এত দিন সেসবের সঙ্গে লড়াই করে টিকেছিলেন এই শিল্পী, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আজ ভোর ৬টা ২০ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান মেয়ে ফারহিন খান জয়িতা, মেয়েজামাই মুস্তাফিজ শাহিন, সহকর্মী, বহু শিক্ষার্থী ও গুণগ্রাহী।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিতা হকের মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি আজ এক শোকবার্তায় মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

রাষ্ট্রপতি বার্তায় বলেন, বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রসংগীত সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিতা হকের প্রচেষ্টা মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। প্রধানমন্ত্রী মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

খালেদ খানের সঙ্গে জয়িতা ও মিতা হক

শোক প্রকাশ করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রমুখ।  
সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন মিতা হক। এ ছাড়া ছিলেন ছায়ানট সাধারণ সংসদের সদস্য। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। করোনা মহামারির আগেও রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষণ দিতে সারা দেশ ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি।

খালেদ খান ও স্ত্রী মিতা হক
ছবি: সংগৃহীত

আজ আর প্রিয় সংগঠনের ভেতরে নেওয়া হয়নি মিতা হককে। ছায়ানট ভবনের উঠানে লাশবাহী শীতল ভ্যানের ভেতরেই ছিলেন তিনি। বাইরে থেকে ফুল দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান শিল্পী–স্বজনেরা। মিতা হককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিলেন শিল্পীদের অনেকেই। অভিনেতা ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পী বাপ্পা মজুমদার, লাইসা আহমদ লিসা, বুলবুল ইসলাম প্রমুখ।

গাইছেন মিতা হক

মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায়। তিনি প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খানের স্ত্রী। তাঁর চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক। তিনিই মিতা হকের প্রথম শিক্ষক। পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সন্‌জীদা খাতুনের কাছে গান শেখেন তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলাশিল্পী মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে গান শেখা শুরু করেন।

মিতা হক বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’, সংগীতায়োজন করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। দুই শতাধিক রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন মিতা হক। এককভাবে মুক্তি পেয়েছে তাঁর মোট ২৪টি অ্যালবাম।

মিতা হক

এর ১৪টি ভারত থেকে ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে। তিনি ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে। ‘সুরতীর্থ’ নামে একটি গানের স্কুলও রয়েছে তাঁর।
একসময় ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতিও ছিলেন। মিতা হক পাঁচ বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিয়ে ভালো ছিলেন তিনি। তবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলেন তিনি।

মিতা হককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিলেন শিল্পীদের অনেকেই