মেধাস্বত্ব বুঝে নিচ্ছেন শিল্পীরা

শিল্পীসমাজের অনেকেই এখন মেধাস্বত্বের প্রশ্নে সোচ্চারছবি: কোলাজ

ময়মনসিংহের তরুণ গীতিকার নয়ন রাজার লেখা ‘কেন এলে না’ গানটি বেহাত হয়ে যায় ২০০৩ সালে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে সে গান ছড়িয়ে পড়ে, কখনো লোকগান হিসেবে, কখনো রাধারমণ দত্তের গান হিসেবে। নয়ন না পেয়েছেন গীতিকবির স্বীকৃতি, না পেয়েছেন রয়্যালটি। অবশেষে ২০২১ সালে গানটির কপিরাইট পান তিনি। নয়ন রাজার মতো শিল্পীসমাজের অনেকেই এখন মেধাস্বত্বের প্রশ্নে সোচ্চার। বুঝে নিতে শুরু করেছেন নিজের মেধাসম্পদের মালিকানা।
মেধাস্বত্ব একধরনের সম্পত্তি। অনেকটাই জমিজমার মতো। এই সম্পত্তি রক্ষার জন্যও নিবন্ধন প্রয়োজন। যাতে মেধাসম্পদ ভোগ করতে পারেন উত্তরাধিকারেরা। আইন অনুসারে শিল্পকর্মের স্রষ্টা বা উদ্ভাবক তাঁর জীবনকাল ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত এর মালিকানা দাবি করতে পারেন। একটা সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে উদাসীন ছিল আমাদের শিল্পীসমাজ। বিগত কয়েক বছর এবং বিশেষ করে করোনাকালে নানা সংকটে শিল্পীরা সচেতন হয়েছেন। সোচ্চার হচ্ছেন অধিকার আদায়ে। বিশেষ করে সংগীতাঙ্গনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে কপিরাইট অধিকারের বিষয়টি।

আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের অডিও বাজার ছিল চাঙা। সারা বছরই প্রকাশ করা হতো গানের নতুন অ্যালবাম। সে সময় এককালীন কিছু টাকা দিয়ে গানের চিরস্থায়ী মালিক হওয়ার অলিখিত নিয়ম ছিল। চলচ্চিত্রের গানেও ছিল প্রযোজকের স্থায়ী অধিকার।

দেখা যেত, প্রযোজকেরা শিল্পীদের অ্যালবামের গানগুলো নিজের মতো করে নানা উপায়ে বারবার বাজারে ছাড়তেন। যথাযথ অনুমোদন ছাড়া অন্যের গানের সুর বা কথা নকল করে বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন করতেন অনেকে। মূল মালিকের অনুমতি ছাড়া গান আপলোড করতে দেখা গেছে ইউটিউবে।

আগারগাঁওয়ের কপিরাইট অফিস

এমনকি গানের দল নিয়েও তৈরি হচ্ছে জটিলতা। এ রীতিতে দাড়ি টেনেছেন শিল্পীরা। তাঁদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়েছে সক্রিয়। কপিরাইট অফিস নানা সময় কপিরাইট-সচেতনতায় শিল্পীদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও নিয়েছে কার্যকর নানা উদ্যোগ। মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে আলাপ, সচেতনতা সৃষ্টি ও বাস্তবায়নে কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকারদের বেশ কিছু সংগঠন ও প্ল্যাটফর্মও উদ্যোগ নিয়েছে। করোনাকালে এসব সংগঠনের প্রতিনিধিরা তৎপর ছিলেন। করোনাকালে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন দেশের প্রথম সারির গীতিকবিরা। গত বছরের ২৪ জুলাই তাঁরা চালু করেন ‘গীতিকবি সংঘ’ নামে একটি সংগঠন। এরপরই আত্মপ্রকাশ করে মিউজিক কম্পোজারস অ্যাসোসিয়েশন এবং কণ্ঠশিল্পী পরিষদ।
এসব উদ্যোগের সুফলও মিলছে। কপিরাইট অফিসের মধ্যস্থতায় ইতিমধ্যে সংগীতাঙ্গনের বেশ কিছু জটিলতার মীমাংসা হয়েছে। কয়েক বছর আগের আলোচিত ‘আমি তো ভালা না, ভালা লইয়াই থাইকো’ গানটির গীতিকার-সুরকারের অধিকার নিশ্চিত করেছে তারা। ফিডব্যাক ও মাকসুদের গানের স্বত্ব–জটিলতায় গানগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি রয়্যালটির সুষম বণ্টন নিশ্চিতে ফিডব্যাক ও মাকসুদের মধ্যে সমঝোতা হয়। এভাবে মাইলস, শিরোনামহীন, ওয়ারফেজ, সরলপুর ব্যান্ডের গানগুলোর স্বীকৃতিরও সমাধান হয়। এ-সংক্রান্ত অভিযোগ করে বিভিন্ন সময় সমাধান পেয়েছেন শিল্পী ফরিদা পারভীন, দিলরুবা খান, শুভ্র দেব, সেলিম চৌধুরী, মনির খান প্রমুখ।

২০১৭ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে কপিরাইট নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৫০। ২০২০ সালে মহামারির মধ্যেও ৩ হাজার ৬২১টি নিবন্ধন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রয়্যালটি নিয়ে শত শত অভিযোগ ছিল। গীতিকার-সুরকারেরা প্রায়ই অভিযোগ দিতেন, তাঁরা রয়্যালটি পাচ্ছেন না। নিজের গান নিজে ইউটিউবে আপলোড করতে বাধার মুখে পড়ছেন। নিবন্ধিত গানের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগের নিষ্পত্তি করা সহজ হয়।’
পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো সংস্কার এবং বাড়তি উদ্যোগের প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংগীতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা মনে করেন, উত্তরণের উপায় হচ্ছে মিউজিক্যাল বোর্ড গঠন।

কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘এত দিন শিল্পীরা সৃষ্টিতেই মগ্ন ছিলেন, অর্থের পেছনে ছোটেননি। কিন্তু তাঁদের সৃষ্টির ফল দীর্ঘদিন ধরে চলে যাচ্ছে অন্যের ঘরে। শিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টিকে অবলম্বন করেই স্বাবলম্বী হতে চান। যদি সিস্টেম অনুযায়ী শিল্পীর মেধাস্বত্বের অধিকার বাস্তবায়িত হয়, তাহলে শিল্পীরা সংকটে কারও মুখাপেক্ষী হবেন না।’
গীতিকবি আসিফ ইকবাল বলেন, ‘সংগীতচর্চা শুধু শখ নয়, পেশা হিসেবে নেওয়া যায়। সম্মিলিতভাবে ক্ষেত্র তৈরি করে পরের প্রজন্মের জন্য ন্যায্য প্রাপ্তির পথ বের করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে কপিরাইট ক্লেইম বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে, যা শিল্পীদের নিবন্ধিত গানের রয়্যালটি নিশ্চিতে কাজ করে। আমাদের দেশেও সব সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মিউজিক বোর্ড গঠন জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।