রাহুল প্রায়ই বলতেন, ‘আমি কুমিল্লার পোলা, বাঙ্গাল’

উপমহাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি রাহুল দেববর্মন। তিনি ছিলেন একাধারে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক ও সুরকার। জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায়, ত্রিপুরার এক সংগীতপ্রেমী রাজপরিবারে। আজ সুবিখ্যাত সুরকার ও শিল্পী রাহুল দেববর্মনের ৮৪তম জন্মদিন। ১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা গানের কর্তা হিসেবে খ্যাত শচীন দেববর্মনের পুত্র রাহুলের। অসংখ্য জনপ্রিয় হিন্দি, বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মন। জন্মদিনের সূত্রে তাঁকে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের সংগীতজগতের পরিচিত মুখ, অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। এখানে থাকল তাঁর লেখার শেষ কিস্তি।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশেই শচীন দেববর্মনের বেড়ে ওঠা। তাঁর আজীবন দুর্বলতা বাংলাদেশের প্রতি। চলনে, বলনে যেন ফেলে আসা পূর্ব বাংলার লোকই ছিলেন সারা জীবন। কে কী ভাবল, এই সব তোয়াক্কা না করে অবলীলায় পূর্ব বাংলার মেঠো ভাষায় কথা বলে যেতেন। রাহুল কলকাতায় বড় হয়েছেন। কিন্তু পারিবারিক ইতিহাস, বাসার পরিবেশ, শচীনকর্তার প্রভাব—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রতি রাহুলের অন্য ধরনের আবেগ ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে যায়। রাহুলের এই আবেগের কথা তাঁর আশপাশের লোকজন জানতেন। একটা বড় প্রশ্ন—বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রতি তাঁর মনোভাব কেমন ছিল? এই প্রশ্নের তেমন কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। তবে যোগ্যতা থাকলে তিনি বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে এবং প্রয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
১৯৮৬ সালে মুক্তি পায়, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি হিন্দি ও বাংলা ভাষায় নির্মিত ‘শত্রু’। প্রমোদ চক্রবর্তী পরিচালিত এই ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন রাহুল দেববর্মন। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজেশ খান্না। ‘শত্রু’ ছবিতে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন। একটি গান হচ্ছে ‘ম্যায় তেরা বিসমিল হুঁ’, অন্যটি হচ্ছে ‘সুরজ, চান্দা-সাগর, পর্বত’। রাহুল তাঁর নিজের বাসায় যাওয়ার অনুমতি এন্ড্রুকে দিয়েছিলেন। বাড়তি যত্নের ছোঁয়াও এন্ড্রু কিশোর পেয়েছেন। এই প্রাপ্তির কথা এন্ড্রু কিশোর ব্যক্তিগত আলাপ ও পত্রপত্রিকায় বলেছেন।

গান গাইতে গিয়ে এন্ড্রুর হিন্দি উচ্চারণে সমস্যা হচ্ছিল। রাহুল তাঁকে গানের গীতিকার আনন্দ বকশির কাছে নিয়ে গেলেন। গীতিকবি তখন পানের বাটা পাশে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। রাহুল তাঁকে ঘুম থেকে তুললেন। ঘুম থেকেই উঠেই তিনি প্রথমে পান মুখে দিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, সমস্যা কী?

রাহুল দেববর্মন

সমস্যা শুনে, আনন্দ বকশি নিজেই সুরে সুরে গাইলেন এবং এন্ড্রুকে ভালো করে শুনে মার্ক করে নিতে বললেন। রেকর্ডিংয়ের দিন স্টুডিওতে আশা ভোসলেকে আনা হলো। আশাজি খুব সুন্দর করে গান গেয়ে শোনালেন এবং এন্ড্রুকে গান ধরিয়ে দিলেন। এন্ড্রুর ভুলত্রুটিগুলো ঠিক করে দিলেন।
এন্ড্রু জানান, রাহুল তাঁকে আদর করে ‘ঢাকাইয়া’ সম্বোধন করতেন। এই ডাকের মধ্যে অপার আন্তরিকতা ছিল। এত সব যত্নের পেছনে, ফেলে আসা দেশের জন্য ভালোবাসাও হয়তো কাজ করেছিল, যে ভালোবাসার কারণে রাহুল প্রায়ই বলতেন, ‘আমি কুমিল্লার পোলা, বাঙ্গাল।’
১৯৯১-৯২-এর দিকে শিল্পী তপন চৌধুরী, শাকিলা জাফরও বোম্বে লিংককিং স্ট্রিটে বাঙালিদের আয়োজনে দুর্গাপূজায় গান করতে গেছেন। সে সময় বয়সে একেবারেই তরুণ পার্থও ছিলেন। তপনরা ঢাকা থেকে মিউজিশিয়ান নিয়ে যাননি। বোম্বে থেকেই নিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনো মিউজিশিয়ান পাচ্ছিলেন না। সবাই ব্যস্ত। অনুষ্ঠানের আগের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মিউজিশিয়ান না পেয়ে সবাই হতাশ। এ অবস্থায় রাতে পূজার অন্যতম আয়োজক বিশিষ্ট চিত্রনির্মাতা শক্তি সামন্তর বাসায় পূজাসংশ্লিষ্ট সবার দাওয়াত ছিল। তপন মিউজিশিয়ান না পাওয়ার কথা শক্তি সামন্তকে বললেন। শক্তিবাবু রাহুলকে ফোন করে জানালেন, ঢাকার ছেলেরা মিউজিশিয়ান পাচ্ছেন না। রাহুল কী বলছে, শোনা গেল না। তবে শক্তিবাবু আবারও বললেন, ‘হা হা বললাম তো ঢাকার ছেলে।’ এরপর কিছুক্ষণ কথা বলে শক্তি সামন্ত ফোন রেখে দেন। তপনদের বলেন, ‘তোমাদের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার পর। বিকেল চারটায় পূজামণ্ডপের মাঠে চলে যাবে। রাহুল ১০ জন মিউজিশিয়ান পাঠিয়ে দেবে। প্র্যাকটিস করে নিয়ো।’

আরও পড়ুন

পূজার দিন ১০ জন ভারতীয় মিউজিশিয়ান নিয়ে তপনরা মঞ্চে উঠলেন। মঞ্চের এক পাশে পার্থ ছিলেন কি-বোর্ডে। কেউ একজন পার্থর কানে কানে বললেন, পঞ্চমদা এসেছেন। পার্থ কি-বোর্ডে মশগুল। আবারও একই কথা বললেন। পার্থর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

আর ডি বর্মনের কাছে গান বুঝে নিচ্ছেন কিশোর কুমার। মাঝে আশা ভোসলে

আবার পার্থকে বলা হলো। তবে এবার ‘পঞ্চমদা’ না বলে, বলা হলো, রাহুল দেববর্মন এসেছেন। এবার বৈদ্যুতিক শকের মতো কাজ হলো। কি-বোর্ড থেকে দুই হাত তুলে পার্থ চিৎকার করে বললেন, ব্রেক ব্রেক! কিছুক্ষণের জন্য গান বন্ধ হয়ে গেল। সবাই রাহুলকে নিয়ে ব্যস্ত। তপন রাহুলের কাছে গিয়ে সুন্দরভাবে নিজেকে পেশ করলেন, ‘দাদা, আমি তপন চৌধুরী, বাংলাদেশ থেকে গান গাইতে এসেছি। আশীর্বাদ করবেন।’ রাহুল হেসে বললেন, ‘আরে আমার লগে এত সুন্দর কইরা কতা (কথা) কইতে হইব না। আমি কুমিল্লার পোলা, বাঙ্গাল…বাঙ্গাল…। ভালো কইরা গান কর…।’
কুমার বিশ্বজিতের মতে, রাহুল দেববর্মন হচ্ছেন ‘গড অব মিউজিক’। রাহুলকে নিয়ে বিশ্বজিতের বিশাল এক স্বপ্ন ছিল। ভাগ্যই সেই স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায় বিশ্বজিৎকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বশক্তিমানের ইচ্ছার কাছে হার মানতে হয়।

আরও পড়ুন

জাপানে এনামুল হক নামের এক ভদ্রলোক অনুষ্ঠান আয়োজক ও প্রোমোটার হিসেবে কাজ করতেন, যিনি এখন নিউইয়র্কের বাফেলো শহরের বাস করেন। কুমার বিশ্বজিতের গানের প্রথম সিডি, জাপান থেকে এনামুল হক প্রকাশ করেন।

গুগল ডুডলে

এই সিডি ভারতের টি-সিরিজ বিনা অনুমতিতে কপি করে ভারতের বাজারে ছেড়ে দেয়। এনামুল বোম্বেতে গিয়ে টি-সিরিজের মালিকের সঙ্গে দেখা করেন। শিল্পী ও তাঁর নিজের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। প্রয়োজনে কোর্টে যাওয়ার কথা বলেন। অনেক দর-কষাকষির পর টি-সিরিজের মালিক গুলশান কুমার আপস ফর্মুলা সামনে আনেন। বিশ্বজিতের গানের অ্যালবাম নিয়ে রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। বিশ্বজিতের গান রাহুল পছন্দ করলে এবং বিশ্বজিতের জন্য গান কম্পোজ করতে রাজি হলে, তিনি টি-সিরিজের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ করবেন বলে কথা দেন।

আরও পড়ুন


এনামুল দেখা করেন রাহুলের সঙ্গে। বাংলাদেশের শিল্পী শুনে রাহুল আগ্রহ দেখান। তবে কঠিন কাজ তখনো বাকি। বিশ্বজিতের গায়কি ও কণ্ঠ তো পছন্দ হতে হবে। এনামুল একটু নার্ভাস। রাহুল গান শোনার জন্য তাড়া দিলে, এনামুল বিশ্বজিতের একটি গানের সিডি এগিয়ে দেন। রাহুল গান শুনে সন্তুষ্ট হন এবং বিশ্বজিতের জন্য একটি পুরো অ্যালবাম করার ব্যাপারেও সম্মতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় রেকর্ডিংয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। বিশ্বজিৎ বোম্বে যাওয়ার সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে আনেন। কিন্তু বিশ্বজিৎ বোম্বের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার আগেই রাহুল দেববর্মন পৃথিবী ত্যাগ করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি।

তথ্যসুত্রঃ

Incomparable Sachin Dev Birman by HQ Chowdhury.

RED FM CANADA

আর ডি এক্স’ আনন্দবাজার পত্রিকা।

ঋণ স্বীকার: রকেট মন্ডল, নকীব খান. তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ।