শুভ জন্মদিন আপা
‘কীরে, ভোরবেলায় তো এসএমএস করলি, আবার ফোন করেছিস কেন?’
এমনভাবে কথা বললেন, যেন তিনি জানেনই না, আজ তাঁর জন্মদিন।
‘এসএমএস করেছি বলে ফোন করতে কি মানা আছে? কেমন আছেন, জানতে চাইব না? আপনার বই খুলে দেখলাম, ১৯৩৩ সালে জন্ম আপনার। শুভ জন্মদিন।’
একটু হাসলেন।
আজকের দিনটা বরাবরের মতো অন্যরকম হতে পারত। সকালে উঠেই দেখতে পেতেন, টেবিলটা ভরে গেছে নানা রকম খাবারে। অনেকেই এসে পড়েছে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে। তিনি বসতেন একটা চেয়ারে। কেউ শোনোত গান, কেউ কবিতা। কেউ বলত কথা।
কিন্তু করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে সে সুযোগ নেই। আজ ৪ এপ্রিল তিনি একাই থাকবেন। যাদের প্রবেশাধিকার আছে, খুব প্রয়োজনে তাঁরা হয়তো যাবেন তাঁর কাছে।
সারা বিশ্বের এই অসহায়ত্ব নিয়ে তিনি খুব বিচলিত। কয়েক দিন ধরে ফোনে কথা হচ্ছে। ছায়ানটের বর্ষবরণ মহড়া বাতিল করে দিয়েছেন তিনি। কেউ কেউ বলছিল, একেবারে বাতিল করা ঠিক হবে না। সীমিত আকারে হোক না অনুষ্ঠান! তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, যেখানে পথে পথে মৃত্যুর হাতছানি, সেখানে সমাবেশ করে বর্ষবরন হতে পারে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই কথা হয় আজ। সকাল নটার দিকে।
২.
সাতাশি হলো সন্জীদা খাতুনের। বয়স তাঁকে শারীরিকভাবে কিছুটা কাবু করেছে। কিন্তু কণ্ঠস্বরে তার ছাপ পড়েনি একেবারে। এখনো যখন ফোনের মাধ্যমে ভেসে আসে তাঁর কণ্ঠ, তখন বুঝতে পারি, বলার মতো করে বলা তাঁর কাছে কতটা জরুরি।
প্রায়ই বলেন, বর্ণমালাটা বুঝে নিতে পারা খুব দরকার। কোনো ধ্বনি কোনখান থেকে তৈরি হয়, সেটা তো জানতে হবে।
গানের মানুষ তিনি। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় কবিতা নিয়ে।
একদিন বললাম, ‘আপনি তো কবিতার ক্লাস নিতে আসতে পারছেন না। একটা কাজ করলে কেমন হয়, ভিডিও ক্লাস নিন। আমরা বড় পর্দায় সেটা দেখাই!’
বেশ কিছুদিন ধরে তিনি খুব প্রয়োজন না হলে ছায়ানটেও আসছেন না। তাই কথাটা মনে ধরল তাঁর। বললেন, ‘একদিন আসিস, করে দেব।’
সকালে বাড়ি গিয়ে দেখি, পরিপাটি হয়ে বসে আছেন টেবিলে। সকালের দিকে তাঁর বাড়িতে গেলে বেশির ভাগ সময় ওখানেই বসে থাকতে দেখি। কিন্তু সেদিন কেন যেন তাঁকে তাঁর মতো লাগছিল না। একটু পর বুঝতে পারলাম, টিপ নেই।
‘টিপ ছাড়া তো হবে না।’
‘কেন, টিপ লাগবে কেন?’
‘টিপ ছাড়া আপনাকে ঠিক আপনার মতো লাগে না।’
কথাটা মানলেন। টিপ পরে এলেন।
‘পরিচয়’ কবিতাটি রেকর্ড করে নিয়েছিলাম সেদিন। রেকর্ড করতে করতে তন্ময় হয়ে লক্ষ্য করছিলাম, তাঁর উচ্চারণ প্রবণতা।
বাংলা ভাষা যে প্রাণহরা—সে কথা বোঝা যায় এ রকম কিছুসংখ্যক মানুষের কণ্ঠে কথা শুনলে।
৩.
‘সকাল থেকে কটা ফোন পেলেন?’
‘অজস্র। কেউ তো আসতে পারছে না, তাই ফোন করছে।’
‘পার্থদা এসেছিলেন?’ (পার্থ তানভীর নভেদ, সন্জীদা খাতুনের ছেলে)।
‘হ্যাঁ। পার্থ এসেছিল ফুল নিয়ে। ছাদের বাগানের ফুল। লিসা (লাইসা আহমদ লিসা, পুত্রবধূ) এসেছিল। ওদের ছেলে সূর্য নাকি আমার জন্য কার্ড বানাচ্ছে। মেয়ে বানাচ্ছে পুডিং।’
‘ফাহমিদা আপা ফোন করেছেন?’
‘হ্যাঁ, ফাহমিদা, মাহমুদা দুজনেই ফোন করেছে।’
তিনি এ কথা বলার পর আমার মনে পড়ে যায়, প্রতি বছর বেলা আরেকটু গড়ালে ফাহমিদা খাতুন আর মাহমুদা খাতুনকে দেখেছি সন্জীদা আপার কাছে চলে আসতে। তিন বোনের একসঙ্গে ছবি তুলেছি কয়েকবার। এবার তাঁরা দূর থেকেই অগ্রজাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
বললাম, ‘একটু খচখচ করছে মন। আপনি একবার আমাকে বলেছিলেন, আপনারা আপনাদের এই আন্দোলনটা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারেননি…’।
‘এটা বলেছিলাম অন্য এক কারণে। আমরা আসলে নিজেরাই কাজটা করি। অন্যের ওপর আস্থা পাই না।
এই আন্দোলন নগরকেন্দ্রিক বলা হচ্ছে। আমরা আসলে কোয়ালিটির কথা ভেবেছি। আমরা নিজেরা কাজ করি তো, তাই অন্য কারও হাতে দিয়ে স্বস্তি পাই না। গুণগত মানটা দরকারি। তবে অন্যভাবে আমরা ছড়িয়ে পড়তে পেরেছি। রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদটা এত শাখায় ছড়ানো, যেভাবে এটার মাধ্যমে সংস্কৃতি চর্চাটা সবখানে ছড়িয়েছে, সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। তবে আমরা জানি, এটা যথেষ্ট নয়। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতে পারিনি।’
এরপর তিনি জানালেন, একটি ছোট লেখা তৈরি করেছেন নূহ উল আলম লেনিনের অনুরোধে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিকথা ধরনের। সেখানে তিনি লিখেছেন, একবার ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুনকে বঙ্গবন্ধু একবার চা খেতে ডেকেছিলেন মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীকে দিয়ে। বলেছিলেন, ‘সুফিয়া কামাল আর সন্জীদা খাতুন ছায়ানট কেন চালাবে। ওটা আমার হাতে দিয়ে দাও।’
তখন সন্জীদা খাতুনেরা এ নিয়ে কিছু বলেননি। যে লেখাটি তৈরি করেছেন, তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা তো নগরেই থেকে গেলাম, তিনি (বঙ্গবন্ধু) হয়তো সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কথাই ভাবছিলেন। সেটা হলে হয়তো এই আন্দোলন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারত। ’
৪.
মানুষটাকে দেখি আর অবাক হই। আপাত প্রশান্ত এই মুখাবয়ব দেখে কি কল্পনা করা যায়, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে মানবমনে প্রথিত করার জন্য কত সংগ্রামই না তিনি করেছেন!
শুরুটা ধরতে পারি ভাষা আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলেই তিনি শুনেছিলেন, গুলি চলেছে। আরও শুনেছেন, ২২ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের একটা সভা হবে টিকাটুলির কামরুন্নেসা স্কুলের গলিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তিনি। ঠিক করলেন, যাবেন সে সভায়। ভীরু মা সন্জীদা খাতুনের পিছ ছাড়বেন না। তিনি মেয়েকে নিয়ে ভয় পেতেন। ফলে মা মেয়ে একসঙ্গে রওনা হলেন। সে সভায়ই সন্জীদা খাতুন প্রথম বক্তৃতা করেছিলেন।
এরপরের বাঁক হিসেবে ধরা যায় ১৯৬১ সালকে। সে সময় তিনি চাকরিজীবী। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সেই সময়টিতেই সন্জীদা খাতুন সংগঠক হিসেবে নিজেকে একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে জিসি দেবের বাড়িতে যে সভা হয়েছিল, তাতে অংশ নেওয়ার জন্য সন্জীদা খাতুনকে চিঠি দিয়েছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (দুই অধ্যাপককেই একাত্তর সালে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা)। এরপর শুরু হলো মহড়া। ডা. নন্দীর বাড়িতে মহড়া হতো। শ্যামার মহড়া হতো। সন্জীদা খাতুনের মনে হতো, এ জায়গাটা অন্যরকম করলে ভালো হতো।শ্যামা যখন ‘নহে নহে এ নহে কৌতুক’ গানের সঙ্গে নাচছে, তখন যে মেয়েটি নাচছে, তাঁর মন বিষণ্ন। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। এ সময় শ্যামার মনে তো রং লেগেছে। ছলের ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। র্যাংকিন স্ট্রিটে মোখলেসুর রহমান সিধু ভাইয়ের বাড়িতেও মহড়া হচ্ছে চিত্রাঙ্গদার। দেখা গেল, চিত্রাঙ্গদার গান গাওয়ার লোক নেই। দুদিনের নোটিশে গান তৈরি করে গাইতে হলো সন্জীদা খাতুনকে।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনগুলি পার হলো। এরপর সিধু ভাইয়ের প্রস্তাবে জয়দেবপুরে বনভোজনে গেলেন সক্রিয় কর্মীদের অনেকে। এদের মধ্যে ছিলেন র্যাংকিন স্ট্রিটের মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), শামসুন্নাহার রহমান (রোজ বু), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকে ভীমরুল ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লিখতেন), মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফউদ্দীন আহমেদ (মানিক)। অন্যান্য অঞ্চল থেকে এসেছিলেন সুফিয়া কামাল, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনসহ উৎসাহী অনেকে। সেখানেই বিকেলের চা-চক্রের সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সমিতি গঠন করা হলো। এভাবেই গড়ে উঠল ছায়ানট।
এরপর তো ছায়ানটের ইতিহাস এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীদের অবদান, বোমা হামলার পরও উন্নত শিরে এগিয়ে চলা বুঝিয়ে দেয়, ছায়ানট টিকে থাকার জন্যই এসেছে। আর এই সংগ্রামের অগ্রবর্তী দলের তূর্যবাদক সন্জীদা খাতুন।
৪.
তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘নিজের ভেতরে শান্তি খুঁজে নিতে হয়’।
কথাটা বলেছিলেন সামগ্রিকভাবে কিছুটা হতাশ হয়ে। একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন যখন। বুঝতে পেরেছিলেন, ছায়ানট বা সংস্কৃতি সংগঠনগুলো দেশের ভেতরে ঢুকে মানুষের মনে সংস্কৃতির আলো জ্বেলে দিতে পারেনি। নাগরিক জীবনে, নাগরিক ভাবনায় হয়তো এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন, কিন্তু গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে যেতে পারেনি সে আন্দোলন। তাই এখন বারবার বলেন, ছুটে যেতে হবে গ্রামে। মুখের কথায় কাজ হবে না। পারফরম্যান্সের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
পয়লা বৈশাখে কিছু অঙ্গীকার করা হয় বটে, কিন্তু তা পালন করে কজন? যে রকম দেখতে চেয়েছিলেন দেশটা, সে রকম যে হয়ে উঠল না, সে আক্ষেপ আছে তাঁর। গ্রামে না গেলে, শহরকেন্দ্রিক হয়ে গেলে সংস্কৃতি বাঁচবে না—এ কথা মনে করেন তিনি।
৫.
কাল ৩ এপ্রিল যখন কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে, তিনি করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলছিলেন। বহুদিন মানবজাতি সামগ্রিকভাবে এ রকম দুঃসময় পার করেনি, এ কথা তিনি বিশ্বাস করেন।। বললেন, এই সংকটকাল কেটে গেলে পৃথিবী দেখবে এক নতুন পৃথিবী।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জন্য একটা বাজেট থাকে। সেই বাজেটের একটা বড় অংশ দেওয়া হয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানকে, যারা দুস্থ মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করে। তিনি খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বলছিলেন, ‘এখন দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার।’
সন্জীদা খাতুন কথা বলছিলেন আর আমি ভাবছিলাম, তিনি যা বলছেন, তার নির্যাস তো একটি বাক্যেই রয়েছে, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই।’