সুরসম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম

ফিরোজা বেগম
ছবি : প্রথম আলো

আজ উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত সংগীত বিশেষজ্ঞের মৃত্যু দিবস। তিনি সংগীত সাধক নজরুল বিশেষজ্ঞ ফিরোজা বেগম। আপার সঙ্গে আমার একটা নিবিড় শ্রদ্ধা-ভক্তি আর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। অনেক স্মৃতি আজ মনে পড়ছে।

সব সময় নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আপাকে নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। নিজে কখনো অনুরোধ করতেন না। সাধারণত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনন্য প্রতিভাবান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার আপাকে নিয়ে নজরুলসংগীতের অসাধারণ একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছিলেন। আপা খুশি হয়ে সব সময় বলতেন, মন্টুর (মুস্তাফা স্যারকে এই নামে ডাকতেন) মতো ওই রকম মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান আর কেউ করতে পারে না। আসলে সত্যি মুস্তাফা মনোয়ারের মতো দ্বিতীয় আর কেউ নেই। কষ্ট এবং দুঃখ, ভিডিওগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি। যদি অনুষ্ঠান সব থাকত তাহলে এ প্রজন্ম মুস্তাফা স্যারের পাণ্ডিত্য আর সৃজনশীলতার কিছু নমুনা জানতে পারত।

যাক আপার প্রসঙ্গে আসি। হঠাৎ একদিন ফোন করে বললেন, ‘মেনকা শোন, তোমাকে একটা অনুরোধ করি।’ আমি বললাম, ‘ছি ছি আপা, অনুরোধ না আপনি আদেশ করেন।’ আপা বললেন, ‘আমার ভাইয়ের মেয়ে সুস্মিতা আনিস ভালো নজরুলসংগীত গায়, আমি অনেক যত্ন করে শিখিয়েছি। কোনো একটা চ্যানেলে অনুষ্ঠান করা যায় কি না।’

অনেক ভেবেচিন্তে চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগরকে আপার অনুরোধের কথা জানালে সম্মতি পেলাম। সাগর অবশ্য আপাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। যথাসময়ে রেকর্ডিংয়ের শিডিউল পেয়ে যাই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন লোকেশনে শুটিং করার সময় আপা সারা দিন আমাদের সঙ্গে থাকলেন। শুধু তা–ই নয়, ভাইয়ের বাসায় আমাদের সবার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন।

কদিন আগে এক সন্ধ্যায় মুগ্ধ হয়ে আপার গান শুনছিলাম। আজ এতগুলো চ্যানেল। কোন চ্যানেল এই প্রতিভাবান শিল্পী ফিরোজা বেগম স্মরণে অনুষ্ঠান প্রচার করবে কিংবা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে যাকে জনগণের চ্যানেল বলা হয়, সেখানে কোনো অনুষ্ঠান হবে কি না, জানা নেই। ফিরোজা বেগম সংগীতকে ভালোবেসে সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের পথে পাড়ি দিয়েছেন।

ফিরোজা বেগম
ছবি : প্রথম আলো

একটা সময়ে চলচ্চিত্রে শুধু সংগীত পরিবেশন নয়, অভিনয়ের সুবর্ণ সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করেন। আধুনিকতার চাকচিক্য তাঁকে তাঁর আদর্শ থেকে সরাতে পারেনি। একসময় নজরুল ইনস্টিটিউটের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তাঁকে সেখান থেকে উৎখাত করা হয়। এত বড় মাপের একজন শিল্পীর জন্য এটা কত বড় অপমানের, একমাত্র সেই বোঝেন। অপরাধ সাবেক রাষ্ট্রপতি ফিরোজা বেগমের গান পছন্দ করতেন। হতেই পারে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী কোনো শিল্পীর গান পছন্দ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, শুধু রাষ্টপ্রধানের পছন্দের কারণে শিল্পীর কপালে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে ক্ষমতার পালাবদলে সেই শিল্পী সরকারি–বেসরকারি সর্বত্র নিষিদ্ধ হয়ে যান। এভাবে কত শিল্পীর মনোকষ্ট এবং মানসিক যন্ত্রণা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আমাদের দেশের অনেক শিল্পী হারিয়ে গেছেন। পাঁচ অথবা দশ বছর অনেক সময় একজনের জন্য। পৃথিবীর কোথাও এমন অনৈতিক নীতি আছে বলে আমার ধারণা নেই। শিল্পী তো কারও ব্যক্তিগত নয়, দশের, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের। এ গতিকে রোধ করে তাঁকে আটকানো মানে দেশের সংস্কৃতিচর্চাকে রোধ করা।

ফিরোজা বেগমের মতো শিল্পীরা প্রতিনিয়ত জন্মান না। সব ভেদাভেদ ভুলে প্রতিটি শিল্পীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া উচিত। এই দৈন্যদশা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যাঁরা ইতিহাস রচনা করেছেন যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে, তাঁদের নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় করে তুলতে হবে। দায়সারা কোনো অনুষ্ঠান করলে তাঁকে অপমানই করা হয়। শুধু ফিরোজা বেগম নয়, অনেক প্রতিভাবান গুণী শিল্পীর জন্ম হয়েছে এই বাংলায়। প্রত্যেককে স্মরণ করে আগামী প্রজন্মকে জানাতে হবে। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে রবীন্দ্র এবং নজরুলজয়ন্তীতে ছোটদের জন্য অনুষ্ঠান, একটি সংগীতানুষ্ঠান এবং একটি নাটক প্রচারিত হতো। ২০০৭ সালের দিকে দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করি, যাতে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। সুরসম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগমের মতো শিল্পীরা প্রতিনিয়ত জন্মান না। সরকারি-বেসরকারি সব চ্যানেল এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সংগীত সাধনায় এই মহান শিল্পীর অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে, এই আবেদন রইল।