১ নম্বর বেশি পেলেন জানে আলম

জানে আলম ছিলেন কণ্ঠশ্রমিক। পাশাপাশি লিখেছেন, সুর করেছেন। প্রায় সব শিল্পীকে দিয়ে গান করিয়েছেন।

ফোনে রিংটোন শোনা গেল না। স্বাগতসংগীত হিসেবে শোনা গেল ‘একটি গন্ধমের লাগিয়া, আল্লায় বানাইলো রে দুনিয়া’ গানটি। রিংটোনের বদলে ফোনে নিজ কণ্ঠে গাওয়া জনপ্রিয় এ গান যুক্ত করে নিয়েছিলেন প্রয়াত শিল্পী জানে আলম। সেই গান বাজতে বাজতে থেমে গেল, কেউ ফোন ধরল না। তাঁর ৪২ বছরের বন্ধু হাসান মতিউর রহমান জানালেন, বাদ আসর (গতকাল বুধবার) মানিকগঞ্জে পারিবারিক কবরস্থানে জানে আলমকে দাফন করা হয়েছে। হরিরামপুরের যাত্রাপুর গ্রামেই জন্মেছিলেন জানে আলম, সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি।

বন্ধু হারিয়ে মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত শিল্পী, গীতিকবি, সংগীত পরিচালক হাসান মতি, এ নামেই তাঁর পরিচিতি। অডিও শিল্পে ৩৫ বছরের ব্যবসা তাঁদের। ভালো ভালো কাজের সুযোগ পেলেও জানে আলম যাননি সেসব করতে। কেবল গানই করে গেছেন। হাসান মতিউর রহমান বলেন, ‘তিনি ছিলেন কণ্ঠশ্রমিক। পাশাপাশি লিখেছেন, সুর করেছেন। প্রায় সব শিল্পীকে দিয়ে গান করিয়েছেন, ক্যাসেট বের করে দিয়েছেন। এমন ভদ্র আর অমায়িক মানুষ হয় না। তিনি সব সময় মানুষের প্রশংসা করতেন, সবাইকে খাওয়াতেন। না খেলে জোর করে খাবার প্যাকেট করে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।’

ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। আমার জীবনের প্রথম অ্যালবামটি তিনি রীতিমতো জোর করেই প্রকাশ করেছিলেন। মানুষটার প্রয়াণের খবর শুনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।
সামিনা চৌধুরী

মাইজভান্ডারি ঘরানার সুফিবাদী গানগুলো তাঁর কণ্ঠে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা প্রায় জনপরিসরে। ‘স্কুল খুইলাছে রে মাওলা’; ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা’; ‘বাবা ভান্ডারি, লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি’সহ আরও কিছু গান। যত দূর জানা যায়, তাঁর লেখা ও সুর করা গানের মধ্যে ‘একটি গন্ধমের লাগিয়া’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ছাড়াও তিনি ছিলেন সংগীত প্রযোজক। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দোয়েল প্রডাকশন থেকে ১৯৮৬ সালে বের হয় সামিনা চৌধুরীর প্রথম অ্যালবাম ‘শৈশবের দিনগুলি’, যে অ্যালবামে ছিল ‘ওই ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায়’ গানটি।

ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষের মতো সব সময় জিজ্ঞেস করতেন, ভাবি ও বাচ্চারা কেমন আছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছ? বাসায় এসো, তোমার ভাবি সব সময় তোমার কথা বলে।
কুমার বিশ্বজিৎ

জানে আলম গান করিয়েছেন তরুণ, নবীনসহ বাংলাদেশের বহু শিল্পীকে। আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, বিপ্লব, মনির খান, এস ডি রুবেল, নাসির আছেন সেই তালিকায়। ক্যাসেট বের করার পাশাপাশি প্রচারণার জন্য শিল্পীদের কনসার্টের আয়োজনও করতেন। স্মৃতিচারণা করে শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘জানে আলম সারা জীবন যা করেছেন, তা এই ইন্ডাস্ট্রির জন্যই করেছেন।’ স্মৃতিচারণা করে গীতিকবি কবির বকুল বলেন, ‘তাঁর সুরের ওপর আমি সত্তরটি গান লিখেছি। আমাদের সম্পর্ক ছিল পারিবারিক। আমার স্ত্রী দিনাত জাহান মুন্নীকে আমার মতো তিনিও মুন্না বলে ডাকতেন।’ পপসংগীতে অবদানের জন্য জানে আলমকে তাঁর সহশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ এগিয়ে রেখেছেন ১ নম্বর বেশি দিয়ে।

তাঁর মতো ভদ্র আর অমায়িক মানুষ হয় না। ভালো ভালো কাজের সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু যাননি, কেবল গান করে গেছেন।
হাসান মতিউর রহমান

শিল্পী জানে আলমের দুই ছেলে—সজল ও সফল। গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁরা মাকে হারিয়েছেন, গত পরশু হারালেন বাবাকেও। ২ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ১০টায় রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে করোনা নেগেটিভ হলেও নিউমোনিয়াসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

ফেরদৌস ওয়াহিদ
ছবি : প্রথম আলো।
আমি সবার চেয়ে জানে আলমকে ১ নম্বর বেশি দিয়ে এগিয়ে রাখব।
ফেরদৌস ওয়াহিদ

যে কারণে নম্বর বেশি দিলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ

আমি, ফিরোজ সাঁই, আজম খান, জানে আলম আর ফকির আলমগীর। লোকে আমাদের বাংলা পপগানের স্রষ্টা ও প্রচারক হিসেবে জানে। এই পাঁচ শিল্পীর মধ্যে জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি কারও কম, কারও বেশি। তবে আমি সবার চেয়ে জানে আলমকে ১ নম্বর বেশি দিয়ে এগিয়ে রাখব।

আমরা যেভাবে গণমাধ্যমে জায়গা পেয়েছি, আলম সেভাবে পায়নি। এদিক থেকে আলম ছিল অবহেলিত। আমরা টাকা ও খ্যাতি অর্জন করে গেছি। আলম সেটা করেনি। সে একাধারে তিনটি কাজ করেছে—গান করেছে, প্রযোজক হিসেবে শিল্পীদের দায়িত্ব নিয়েছে এবং জনপ্রিয় শিল্পী তৈরি করতে কনসার্টের আয়োজন করেছে। কনসার্টের আয়োজক ও সংগীত প্রযোজকেরা নাকি টাকার খনি। জানে আলমের ক্ষেত্রে সেটা ছিল একেবারে উল্টো। তখনকার আয়োজক ও প্রযোজকেরা ছিলেন আমাদের মতো শিল্পীদের জন্য আশীর্বাদ। কারণ, তখন এই অঙ্গনে তেমন টাকাপয়সা ছিল না। কনসার্টের পর আমাদের হাতে অল্প কিছু টাকা তুলে দিত। তাঁর হাতে থাকত সামান্যই।

আমি মনে করি, এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে আলমের মতো গুটিকয় আয়োজক-প্রযোজকের শ্রমের বিনিময়ে।