‘সংস্কৃতির সংকট: রুচির দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় যা বললেন বক্তারা

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে ‘সংস্কৃতির সংকট: রুচির দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়প্রথম আলো

‘নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষমাত্রই রুচিহীন’, ‘কুরুচির লালন–পালন অনেক সময় রুচিমানরাও করে থাকে’, ‘রুচির সংকটটি আসলে রাজনৈতিক সংকট’, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলে এ ধরনের সমস্যা সমাধান করা কঠিন’, ‘পরিবর্তন আনতে হবে রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে’, ‘রাষ্ট্র ছাড়া এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা যাবে না। ’ আজ সকালে ‘সংস্কৃতির সংকট: রুচির দুর্ভিক্ষ’ শিরোনামে মুক্ত আলোচনায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

সম্প্রতি অভিনয়শিল্পী মামুনুর রশীদ মন্তব্য করেন, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ পড়েছে দেশ। যে কারণে কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এমনকি এসব কারণেই সেখান থেকে হিরো আলমদের উত্থান হয়েছে...।’ এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অঙ্গনেও এ নিয়ে চলছে নানা ধরনের কথাবার্তা। সমসাময়িক এই বিষয় নিয়ে ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (এফটিপিও) শনিবার আয়োজন করেছে ‘সংস্কৃতির সংকট: রুচির দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনার। আজ সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় বক্তারা তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন।

বক্তারা বলছেন, ডিজিটাল যুগে সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোনসহ নানা ডিভাইস। ফ্রি প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, ইউটিউবের কল্যাণে অনেকেই নিজস্ব একটা ‘চ্যানেল’–এর মালিক। এসব প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট প্রকাশে কোনো বাধা না থাকায় যে কেউ যেকোনো কিছু প্রকাশ করছে। আর মানহীন, রুচিহীন এবং ক্ষতিকর এই কনটেন্টগুলো ফ্রি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সহজেই তা সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

এই সময় কুরুচিপূর্ণ কনটেন্টের জন্য নির্মাতা ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে দায়ী করেছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলেন, পরিচালকেরা ভিউয়ের জন্য দ্বৈত অর্থবোধক সংলাপ ব্যবহার করেন তাঁদের নাটকে। এর সঙ্গে রয়েছে অশ্লীলতা। কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল সংলাপে ভরপুর এসব কনটেন্ট অনেক ওটিটিতেও প্রচারিত হয়। অনেক সময় টেলিভিশনেও এমন অনেক কনটেন্ট দেখা যায় বলে জানান তাঁরা।

নির্মাতা, নাট্যকার বৃন্দাবন দাস
প্রথম আলো

গীতিকবি সংঘের সভাপতি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বলেন, ‘সংস্কৃতির সংকটের শুরুটা অনেক আগের। স্বাধীনতার পর পর আমরা দেখেছিলাম প্রথম দিকে দেশাত্মবোধক গান হচ্ছে। যেকোনো অনুষ্ঠানে চলছে এই গান। এরপর ১৯৭৪ সালের দিকে শুরু হয় হিন্দি গানের আগ্রাসন। এরপর আজম খান, লাকী আখন্দ্‌ আমাদের উপহার দিল আধুনিক সুন্দর সুন্দর গান। এই গান দিয়ে সরালো হিন্দি গানের আগ্রাসন। তখন থেকে এভাবেই চলে আসছে। এখন এই খারাপ কনটেন্টকে সরাতে হলে আমাদের ভালো ভালো কাজ করে যেতে হবে। এত বেশি ভালো কাজ করতে হবে, মানুষ খারাপ কাজগুলো ফেলে এই ভালো কাজগুলোর দিকে যাতে ঝুঁকে।’

সংস্কৃতির এই সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখছেন অনেকে। আক্ষেপ নিয়ে নির্মাতা, নাট্যকার বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘আগে রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু এখন ছাত্রসংগঠনের কাউকে সংস্কৃতি অঙ্গনে দেখা যায় না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলে আসলে সমস্যা সমাধান করা কঠিন।’

আলোচনা সভার শুরুতে অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সেখানে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়াতে নানাভাবে দুর্ভিক্ষের প্রাচুর্য লক্ষ করা যাচ্ছে। কিছু কিছু টিভি নাটক, ওটিটিসহ নিউ মিডিয়ার কিছু কিছু কনটেন্ট ও অনুষ্ঠানে ঘটনার বর্ণনা এবং বক্তব্যের অন্তঃসারশূন্য, নানাবিধ বিকৃতি ও অশ্লীলতা আমাদের শিল্পের সৌন্দর্য ও গৌরবকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং মানুষের রুচিকে নিম্নগামী করে দিচ্ছে। চলচ্চিত্রে একসময়ে প্রবল রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সুষ্ঠু চলচ্চিত্রের নির্মাতারা বসে গিয়েছিলেন। কিন্তু দর্শক সেসব রুচিহীন চলচ্চিত্র প্রত্যাখ্যান করায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারীরা বেশি দূর এগোতে পারেননি।

সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকদের প্রবেশমূল্য দিয়ে তা দেখতে হয়। তাই সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে দর্শকের একটা সুযোগ থাকে সে কী দেখবে, কী দেখবে না—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু নিউ মিডিয়ার অনুষ্ঠান বা কনটেন্ট বিনা মূল্যে বাধাহীনভাবে পৌঁছে যায় মানুষের হাতের মুঠোয়। তাই নানা মাত্রা ও আঙ্গিকে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে দর্শকের ওপর। বিশেষ করে সামাজিক অবক্ষয় এবং নানাবিধ কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টির ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়। নিউ মিডিয়ায় যুক্ত মাধ্যমে একদিকে সংস্কৃতিবিবর্জিত কিছু ব্যক্তির কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য এবং পাশাপাশি উদ্ভট ও রুচিহীন সিনেমা, নাটক ও অনুষ্ঠানের অব্যাহত প্রচার মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করছে। এর ফলে রুচির দুর্ভিক্ষে পড়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

আফসানা মিমি
প্রথম আলো

সংস্কৃতির সংকট প্রসঙ্গে নির্মাতা ও উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষার বলেন, ‘এই সংস্কৃতির সংকট আজকে সৃষ্টি হয় নাই। দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হয়েছে এই সংকট। এর পেছনে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে, আমাদেরও দায় রয়েছে। আমাদের অনেক সংগঠন রয়েছে, আছে আমাদের অনেক ঐক্যও। কিন্তু আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি আমাদের চোখের সামনে বাতির নিচে অন্ধকার তৈরি হচ্ছে। আমরা যতই আলো জ্বালাই না কেন, এই অন্ধকারকে দূর করতে সক্রিয় হতে পারিনি। মামুনুর রশীদের বক্তব্যের পর আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়েছে আমাদের সামনে একটা রুচির দুর্ভিক্ষ আছে এবং রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে।’

লিখিত বক্তব্যে আহসান হাবিব নাসিম আরও বলেন, রুচির এই চলমান দুর্ভিক্ষ দূর না হলে সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের সুদূরপ্রসারী ফলাফলের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি দল তাঁর নামে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল কথা বলে অসম্মান করছে এবং তার এই বক্তব্যকে বিতর্কিত করছে। ফেসবুক সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় যে যা ইচ্ছা লিখতে এবং বলতে পারে। কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি মন্তব্য তুলে দেওয়া হয় লিখিত বক্তব্যে, ‘সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশ্যে অসম্মান করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ফেসবুক। আমার কোনো কবিতাই পড়েনি, এ রকম যদুরাও আমাকে ভর্ৎসনা করেছে কত। সম্মানীয় মানুষদের অসম্মান করে প্রকাশ্যে আনন্দলাভের এই সুবর্ণ সুযোগ ফেসবুকহীন পৃথিবীতে ছিল না। এটা আমি মেনে নিয়েছি। আমার প্রিয় বন্ধু মামুনুর রশীদকেও মেনে নিতে বলি।’

নাট্যকার সংঘের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ ও এফটিপিওর মহাসচিব সালাউদ্দিন লাভলু
প্রথম আলো

মুক্ত আলোচনার সভাপতিত্ব করেন এফটিপিওর মহাসচিব সালাউদ্দিন লাভলু। নাট্যকার সংঘের সভাপতি হারুন-অর-রশিদের সঞ্চালনায় এই সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ, চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান, নির্মাতা ফেরদৌস হাসান, ফজলুর রহমান বাবু, অভিনয়শিল্পী আজাদ আবুল কালাম, আফসানা মিমি, ইরেশ যাকের, শাহনাজ খুশী, গাজী রাকায়েত, আহমেদ গিয়াস, সাজু খাদেম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে নাট্যজন মামুনুর রশীদ উপস্থিতি ছিলেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তবে তিনি নিজে কোনো কথা বলেননি। অন্য আলোচকেরা বলেন, আজ আমরা মামুন ভাইয়ের কথাই বলতে এসেছি, বলব।