উঠে আসছে ছোট শহরের গল্প

হিন্দি ছবি ‘তনু ওয়েডস’ মনু মুক্তির পর ব্যাপকভাবে ব্যবসাসফল হয়। তখন সমালোচকেরা বলেছিলেন, মুম্বাই, দিল্লির মতো দর্শকের কাছে অতি পরিচিত লোকেশন থেকে বেরিয়ে কানপুরের প্রেক্ষাপটে দারুণভাবে বলা গল্প ছবিটি গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার অন্যতম কারণ। হিট ফরমুলা মেনে পরিচালক আনন্দ এল রাই এরপর পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন ‘রানঝানা’, ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’, ‘হ্যাপি ভাগ জায়েগি’, ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’-এর মতো ছবি। যার সব কটিই মূলত ছোট শহরের প্রেক্ষাপটে বলা গল্প। এরপর পরিচালক আনন্দ এল রাই পরিচিতি পান ‘স্মল টাউন স্টোরিটেলার’ হিসেবে। কেবল তিনিই নন, গত এক দশকে ছোট শহরের প্রেক্ষাপটে এরপর প্রচুর ছবি বানিয়েছেন হিন্দি সিনেমার পরিচালকেরা, যার অনেকগুলোই হিট হয়েছে।

গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’–এর শুটিং হয়েছে ময়মনসিংহে
ছবি: সংগৃহীত

‘ন ডরাই’, ‘সাহস’, ‘শাটিকাপ’-এর মতো কাজ দিয়ে ইদানীং বাংলাদেশেও এ ধরনের গল্প বলার প্রবণতা বাড়ছে। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন, এ ধরনের সিনেমা বা সিরিজে বৈচিত্র্যের স্বাদ পাওয়া যায়। বিশ্বাসযোগ্যভাবে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার গল্প তুলে ধরা হলে সেটি দর্শককে আকৃষ্ট করে।

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ করে ধারাবাহিকভাবে সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রায়হান রাফি। পরিচালকের ‘পোড়ামন ২’ ছবির দৃশ্য
ছবি : সংগৃহীত

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ করে ধারাবাহিকভাবে সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রায়হান রাফি। ‘পোড়ামন ২’ থেকে গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’-এ মূলত আঞ্চলিক গল্পই বলেছেন তিনি। প্রথমটির শুটিং হয় কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে। দ্বিতীয়টির ময়মনসিংহে। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা আরেকটি ছবি ‘নূর’-ও তিনি বানিয়েছেন পাবনার প্রেক্ষাপটে। একের পর এক মফস্বল শহরের গল্প নিয়ে সিনেমা করা কি পরিকল্পিত? রাফি বললেন, ‘গ্রাম-মফস্বল আমাকে টানে। ঢাকায় শুট করি খুব কম। ঢাকায় যারা বাস করে, বেশির ভাগেরই শিকড় পেছনে। ঢাকার মানুষের আসলে সেভাবে স্বকীয়তা নেই, বেশির ভাগই দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা। মেহেরপুরের, সৈয়দপুরের বা ময়মনসিংহের একটা নিজস্বতা আছে। আমরা সবাই মফস্বলে বড় হয়েছি। সে টান তো আছেই।’

‘পরাণ’–এর দৃশ্যে শরিফুল রাজ ও মিম
ছবি: সংগৃহীত

এই পরিচালকের সিনেমায় গানের চিত্রায়ণও আলাদাভাবে দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে। তিনি মনে করেন, মফস্বল শহরে চিত্রায়ণের কারণে সিনেমার গানগুলো ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। রাফি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমার কোনো সিনেমার গান বিদেশে শুটিং করিনি। বাংলাদেশে একটা উদ্ভট রেওয়াজ ছিল, রোমান্টিক গান মানেই বিদেশে শুটিং, যা একেবারেই অযৌক্তিক। আমিও বাণিজ্যিক ছবি বানাই, কিন্তু ছবিতে গান হয় রিয়েল লোকেশনে। পোড়ামন ২-এর গান করেছি গ্রামে, পরাণ-এর গান হয়েছে ময়মনসিংহে। গান কিন্তু সুপারহিট। একটা গান নেপালে, একটা তুরস্কে—এভাবে করলে দর্শকও কানেক্ট করতে পারে না। দর্শক এখন অনেক স্মার্ট। রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচে সিনেমা বানাতে হবে।’

পুরোপুরি বাগেরহাটের প্রচলিত ভাষায় তৈরি সিনেমাটি আঞ্চলিক নিজস্বতার জন্য প্রশংসিত হয় ‘সাহস’
ছবি: চরকির সৌজন্যে

চলতি বছরের জুনে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিতে মুক্তি পায় সাজ্জাদ খানের ছবি ‘সাহস’। পুরোপুরি বাগেরহাটের প্রচলিত ভাষায় তৈরি সিনেমাটি আঞ্চলিক নিজস্বতার জন্য প্রশংসিত হয়। পরিচালক মনে করেন, পর্দায় নিজের দেশের নানা প্রান্তের গল্প যত বেশি দেখবেন, মানুষ তত বেশি গল্পের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবেন। সাজ্জাদ এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দিলেন গত ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমার। ‘দর্শক কিন্তু আমাদের নিজস্ব গল্পই পছন্দ করেছেন। এই যে আমরা তামিল ছবি রিমেক করি বা নকল করি, যা দেখে দর্শক নিজেকের সঙ্গে মেলাতে পারেন না। যখন নিজেদের কোনো গল্প বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা হয়, মানুষ পছন্দ করেন। মনপুরার ক্ষেত্রেও যেটা হয়েছিল।’

সাহস’–এর একটি দৃশ্য

এই পরিচালক নিজের পরের ছবিও বানাচ্ছেন ঢাকার আশপাশের তিন অঞ্চলের তিন গল্প নিয়ে। তবে পরিচালক তানিম রহমান মনে করেন, কেবল বৈচিত্র্যময় আঞ্চলিক গল্প বললেই হবে না, পর্দায় সেটা ঠিকঠাক তুলেও ধরতে হবে। ২০১৯ সালে তিনি তাঁর ‘ন ডরাই’ বানিয়েছিলেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সার্ফারদের দিয়ে। ছয়টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ছবিটি। তানিম নিজেও পান সেরা পরিচালকের পুরস্কার। তিনি জানান, শুটিং শুরুর আগে তিন বছর গবেষণা করেছেন তিনি। তানিম বলেন, ‘যে ঘটনা বা যাদের নিয়ে গল্প, তাদের সঙ্গে মিশতে হয়, তাদের সম্পর্কে জানতে হয়। এ জন্য যথেষ্ট গবেষণা জরুরি। কারণ, সত্যিকারের প্রেক্ষাপট পর্দায় তুলে ধরতে না পারলে সেটা সহজেই ধরা পড়বে।’

‘শাটিকাপ’ মুক্তির পর দেশে তো বটেই, ভারতের অনেক ইউটিউবার সিরিজটির তারিফ করেছেন
ছবি : সংগৃহীত

রাজশাহীর প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিরিজ ‘শাটিকাপ’ চলতি বছর চরকিতে মুক্তির পর ব্যাপক সাড়া ফেলে। দেশে তো বটেই, ভারতের অনেক ইউটিউবার সিরিজটির তারিফ করেছেন। অনেক সমালোচকের মতে, গল্প, নির্মাণ, ভাষা আর রাজশাহীর নিজস্বতা মিলিয়ে শাটিকাপ ছিল তাজা হাওয়ার মতোই। সিরিজের পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম রাজশাহীরই ছেলে। পর্দায় ছোট শহরের প্রেক্ষাপটে বলা গল্প দর্শককে কতটা আকৃষ্ট করে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশটা ছোট হলেও ঘনবসতিপূর্ণ। নিজের জায়গা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে গেলেই দেখবেন ভাষার কত পার্থক্য। মানুষের জীবনযাপন, সমাজের মধ্যে আলাদা নিজস্বতা দেখা যায়। এ জন্য আমাদের না–বলা গল্পের সংখ্যাও অনেক। আমার তো মনে হয়, বাংলাদেশ গল্পের খনি, যার অনেকগুলোই ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এই গল্পগুলো বলতে পারলে হয়তো দেশি ও বিদেশি দর্শকের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করবে। গল্পগুলো যাঁদের জানা, তাঁরা সহজেই নিজের সঙ্গে মেলাতে পারবেন। যাঁদের জানা নেই, তাঁদের নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আমার মনে হয়, আঞ্চলিক যে গল্পগুলো বিভিন্ন জায়গায় আছে, সেগুলো নিয়ে নতুন অনেক ইন্টারেস্টিং কাজ হতে পারে।’

একজন–দুজন নয়, ১৩৭ জন অভিনয়শিল্পী এক সিরিজে!
ছবি : সংগৃহীত

চলতি বছর ‘সাহস’ ও ‘শাটিকাপ’ মুক্তি পেয়েছিল ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিতে। এ ধরনের কাজ প্রসঙ্গে চরকির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি বলেন, ‘আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আমাদের দেশের নিজস্ব গল্পকে প্রকাশ করা। বাংলাদেশের যদি নিজস্ব গল্প বলি, তাহলে সেটা কিন্তু শুধু ঢাকার গল্প নয়, সারা দেশের গল্প। সে গল্প কত বৈচিত্র্যময়! সিলেটের গল্প এক রকম, চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর গল্প আরেক রকম। প্রতিটি জায়গারই ভিন্নতা আছে, বিভিন্ন ধরনের চরিত্র আছে, যেটা খুবই ইন্টারেস্টিং। সেটা সুখের গল্প হোক, দুঃখের গল্প হোক।’ রেদওয়ান রনি জানান, আরও আঞ্চলিক কনটেন্ট নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে চরকি। এ ছাড়া আট অঞ্চলের আলাদা অরিজিনাল কনটেন্ট নিয়ে আসতে যাচ্ছে চরকি। যে কনটেন্টগুলোতে দেখা যাবে ওই অঞ্চলের স্থানীয় শিল্পীদের।