ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে তিনি হয়ে ছিলেন আলীবাবা, গোপাল ভাঁড়

পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় যাঁকে সর্বাধিক ব্যবহার করেছেন, তিনি সন্তোষ দত্তকোলাজ

সে দৃশ্য ভোলার নয়। জয় বাবা ফেলুনাথ। মগনলাল মেঘরাজের ডেরা। দৃশ্যটা এমন, জটায়ুকে দাঁড় করানো হয়েছে গোল চাকতিতে পিঠ ঠেকিয়ে। উল্টো দিকে ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধ শাগরেদ ‘অর্জুন’ কামু। অর্জুনের হাতের ছোরা একে একে গিয়ে বিঁধবে জটায়ুর আশপাশে।

আরেকটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির। শেষের দিকে। রাজ্যের সবাই যুদ্ধ ভুলে হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে দৌড়চ্ছে…আর তারই মধ্যে একজন সীমাহীন আনন্দে দুই হাত তুলে মুক্তির আনন্দ উদ্‌যাপন করছে…‘ছুটি, ছুটি!’ সেই সংলাপগুলোও মনে পড়ে, ‘উট কি কাঁটা বেছে খায়!’, ‘রাজকন্যা কি কম পড়িয়াছে?’, ‘জাপানি স্যুটকেস হ্যায়, ইমপোর্টেড’, ‘মেরা সাম্প্রতিকতম উপন্যাস’। এসবের পেছনে একটি নাম, সন্তোষ দত্ত।
গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় যাঁকে সর্বাধিক ব্যবহার করেছেন, তিনি সন্তোষ দত্ত। একে একে আটটি ছবি! ফেলুদার ছায়াসঙ্গী জটায়ুর কথা বললে তাঁর মুখই ভেসে আসে বাঙালির মনে।
সন্তোষ দত্তর শিল্পীসত্তা ছিল বহুমুখী, বৈচিত্র্যময়। আজ তাঁর জন্মদিন। আদি নিবাস ঢাকা। ২ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন সন্তোষ দত্ত। ১৯৮৮ সালের ৫ মার্চ জাগতিক ভ্রমণ শেষ করেন, ক্যানসারে মারা যান তিনি।
পেশায় তিনি ছিলেন আইনজীবী। যদিও প্রথম জীবনে ব্যাংকের চাকরিও করেছেন প্রায় ১৪ বছর, ওডিশায় বদলির আদেশ এলে চাকরিও ছাড়েন হঠাৎ করে। ওকালতি নিয়ে পড়াশোনা ছিল, তাই হয়তো চলে এলেন আইনজীবীর পেশায়। ক্রিমিনাল লয়ার হিসেবে আদালতে জেরা করতেন।

অভিনেতা মনোজ মিত্র ভারতীয় গণমাধ্যমে এ সময়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ক্রিমিনাল লয়ার হিসেবে আদালতে সওয়াল করতে দেখেছি তাঁকে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। দোর্দণ্ড প্রতাপ সন্তোষ দত্ত প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে তুখোড় ইংরেজিতে একের পর এক প্রশ্নবাণে ধরাশায়ী করে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে। দেখতে দেখতে গুলিয়ে যায়, এই লোকই সত্যজিৎ রায়ের ছবির সেই চরিত্র, যিনি একটা সঠিক ইংরেজি বলতে গিয়ে ১০ বার হোঁচট খেয়েও শেষমেশ অবধারিতভাবে ভুল বলে। কিংবা প্রচণ্ড সিরিয়াস কন্ডিশনে দুরন্ত টাইমিংয়ে ফেলুদা আর তোপসের মাঝে জবুথবু হয়ে বসে হঠাৎ প্রশ্ন করে, উট কি কাঁটা বেছে খায়?’

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির দৃশ্যে
ফেসবুক থেকে

মনোজ মিত্র আরেক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ‘সন্তোষদা কমেডির সময় নিজের ম্যাচিউরিটি লেভেলকে একেবারে শিশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনতেন। তাঁর অঙ্গভঙ্গি, হাত-পা ছোড়া, ভয় ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে মিশে যেত পাঁচ-ছয় বছরের শিশু। এই পুরো ব্যাপারটাই উনি করতেন ভীষণ বিশ্বাসযোগ্যভাবে। এটা আসলে যে ঠিক কতটা কঠিন, তা যাঁরা অভিনয় করেন, বোঝেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন।’
সন্তোষ দত্তকে যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের প্রায় সময় একটা কথা মনে হতো, তাঁর দুটো সত্তা—একটা মঞ্চের বা পর্দার, যেখানে তাঁকে মনে হতো আলুথালু একজন মানুষ; সেই মানুষ আবার যখন বাস্তব জীবনে ঢুকতেন, ছবিটি পুরো বদলে যেত!

সে সময় কলকাতার ‘রূপকার’ নাট্যগোষ্ঠীর ‘চলচ্চিত্রচঞ্চরী’তে ‘ভবদুলাল’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। আর সেই নাটক দেখে তাঁকে পছন্দ করেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক শুটিং তারিখ পড়ত সন্তোষ দত্তর কোর্টের মামলার দিনে। সত্যজিতের ছবির শুটিংয়ের তারিখ বদলানো বা বাতিল করা সহজ ছিল না। আবার অন্যদিকে ‘সোনার কেল্লা’র শুটিং রাজস্থানে আউটডোর থেকে ‘হীরক রাজার দেশে’র শুটিং পুরুলিয়া। এদিকে আদালতের ধার্য তারিখ মুলতবি করাও সম্ভব ছিল না তখন। কিন্তু সন্তোষ দত্তকে সে সময় সবাই এত ভালোবাসতেন যে বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরাও তাঁর সঙ্গে মিল রেখে তারিখ নির্ধারণ করতেন। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘তুলসী চক্রবর্তী, উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্তর মতো অভিনেতারা বিদেশে জন্মালে একাধিক অস্কার পেতে পারতেন।’

ফেলুদার ছায়াসঙ্গী জটায়ুর কথা বললে তাঁর মুখই ভেসে আসে বাঙালির মনে
ইউটিউব থেকে

মঞ্চে অভিনয় দেখেই সত্যজিৎ রায় তাঁকে ‘পরশপাথর’ ছবির জন্য নির্বাচন করেছিলেন। যাঁরা দেখেছেন ছবিটি, তাঁরা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ঘোষককে। অনেকে বলেন, জটায়ু চরিত্রে তাঁর কোনো বিকল্প নেই।
তাঁদের মতে, রবি ঘোষ, অনুপ কুমার, বিভু ভট্টাচার্যরা পরে জটায়ু করলেও তাঁরা কেউই সন্তোষ দত্তর মতো হয়ে উঠতে পারেননি। বেশির ভাগ দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন ‘ফেলুদা’ সিরিজের জটায়ু অথবা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর শুন্ডিরাজা হিসেবে। তা ছাড়াও কিছু কাজ রয়েছে তাঁর। আজ প্রয়াণদিবসে মূলত সেসব চরিত্র নিয়ে কিছুটা জানব।

আরও একবার স্মরণ করা যাক সেই চরিত্রগুলোর কথা—


কিশোরী চাটুজ্যে (সমাপ্তি, ১৯৬১)
ষাটের দশকের বাংলায় প্রত্যন্ত এক গ্রামের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার এই চরিত্র খুব বেশি কিছু কথা না বলে অনেক কিছু বলে। কলকাতায় পড়া শিক্ষিত ছেলের মেয়ে দেখতে যাওয়া থেকে শুরু করে সম্ভাব্য পাত্রের আচমকা কাশির দমক সামাল দেওয়া—সমাপ্তি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই চরিত্রকে কোনো দিন ভুলবেন না।


শুন্ডিরাজা ও হাল্লারাজা (গুপী গাইন বাঘা বাইন, ১৯৬৮)
এ দুটি চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পরবিরোধী এ দুটি চরিত্রেই সন্তোষ দত্ত অসামান্য অভিনয় করেছেন। ভালো রাজার সহজ–সরল অভিব্যক্তি এবং খারাপ রাজার হিংস্র–কুটিল অভিব্যক্তি নিখুঁত অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বিশেষ করে হাল্লারাজার চরিত্রটির কথা না বললে নয়। ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গানের দৃশ্যটির শেষে যখন গুপী তার গান ধরে, যখন একটু একটু করে হাল্লারাজার ওপর বরফির জাদুর প্রভাব কমতে থাকে, চরিত্রের ওই বিবর্তন অনবদ্য। আবার শুন্ডিরাজার চরিত্রটি এমনই সাবলীল, তা কৌতুকপূর্ণ হলেও এত রাজকীয়! অভিনয়ের এই ভারসাম্য অত্যন্ত কঠিন, যা তিনি অত্যন্ত সহজাতভাবে করতেন।

গবেষক (হীরক রাজার দেশে)
সন্তোষ দত্ত অভিনীত সেরা চরিত্রগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে থাকবে এ চরিত্র। যেখানে তিনি সমাজবিমুখ, রাজনৈতিক সচেতনতাবর্জিত এক বিজ্ঞানী, যে তার আবিষ্কারের সম্ভাব্য প্রয়োগ নিয়ে ভাবিত নয়। প্রথম দিকে মনে হয় নিরীহ, কিছুটা লোভী এক জ্ঞানের উপাসক। কিন্তু ছবির শেষের দিকে যখন সে খেপে গিয়ে বলে ওঠে, ‘আমি কারও দলে নই, আমি বিজ্ঞানী’, তখন পরিচালক ঠিক যে বার্তা দিতে চান দর্শককে, তা অসম্ভব দক্ষতায় চোখে আঙুল দিয়ে দর্শককে দেখান অভিনেতা।

গবেষক (হীরক রাজার দেশে)
ইউটিউব থেকে

অবলাকান্ত (ওগো বধূ সুন্দরী)
সন্তোষ দত্তর অন্যতম সেরা অভিনয় এই চরিত্র। নিতান্তই বাণিজ্যিক সিনেমা এবং ছবির বিষয়বস্তুও অগভীর কিন্তু অভিনেতা তাঁর কাজটুকু করেছেন অপরিসীম দক্ষতায়। জনপ্রিয়তার বিচারে চরিত্রটি একটি উদাহরণ, যা নিয়ে চার দশক পরও দর্শক নিয়মিত আলোচনা করেন।


আলীবাবা (মর্জিনা-আবদাল্লা)
এ চরিত্রের কথা না বললেই নয়। এমনিতে চরিত্রটি রূপকথার বইয়ের কারণে চর্চিত। যে চরিত্রের কথা পড়ে বড় হয়েছে, সেই ফ্যান্টাসি চরিত্রে রূপদান নিঃসন্দেহে অভিনেতার জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি। ছবিটি যেমন হোক না কেন, আলীবাবা চরিত্রে সন্তোষ দত্তর অভিনয় চিরস্মরণীয়।

গোপাল ভাঁড়
নামটি কারও অজানা নয়। চর্চিত চরিত্র। এ চরিত্রে ওই সময় সন্তোষ দত্ত ছাড়া আর কোনো অভিনেতাকে ভাবতে পারেননি পরিচালক। তাই আশির দশকে তাঁকে ছাড়া নির্মাতারা যেমন গোপাল ভাঁড়কে ভাবতে পারেননি, দর্শকও পারতেন না।
তবে এ চরিত্রগুলো ছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে, যেগুলোর উল্লেখ প্রয়োজন যেমন ‘জনঅরণ্য’ (১৯৭৬) ছবির হীরালাল সাহা অথবা তাঁর প্রথম ছবি ‘পরশপাথর’–এর (১৯৫৮) অতনু, ‘মহাপুরুষ’-এর (১৯৬৫) প্রফেসর নন্দী অথবা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর (১৯৭৩) নবীন মাস্টার।
ওটিটির যুগে প্রবেশ করেছে বিনোদন দুনিয়া। বিশেষ করে কলকাতায়ও পুরোনো গল্প নিয়ে ওয়েব সিরিজ বা ওয়েব ফিল্ম হচ্ছে। নানাভাবে আসছে পুরোনো চরিত্রগুলো। এ সময়েও লালমোহন বাবু বা অবলাকান্তদের সারল্য খুঁজে পেতে তাঁরই লুকে তৈরি হয় ওয়েব সিরিজের চরিত্র। কিন্তু সন্তোষ দত্তর ওই অভিনয় কি আর অত সহজ! অমন স্বতন্ত্র অভিনয়, সরল অভিব্যক্তির জটায়ু দুই বাংলার দর্শকের কাছে অমর হয়ে থাকবেন, এটা বলাই যায়। ফেলুদার গল্প পড়তে গিয়েই হোক বা সিনেমা দেখতে গিয়ে; সবার আগেই চোখে ভেসে উঠবে তাঁর মুখ।
(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)