ছোটদের কাছে উত্তম ছিলেন ‘ভালো কাকু’

‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমার।
ছবি: সংগৃহীত

মহানায়ক তিনি। তাতে কী? পাড়ার মুচি থেকে নামকরা পরিচালক—সবার সঙ্গেই সখ্য ছিল উত্তমের। যেমন ধরুন, গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে এলেই গাড়ির দরজা খুলে দিতেন পাড়ার এক মুচি। গাড়ি থেকে নেমে রোজ তাঁকে টাকা দিয়ে খুশি করতেন উত্তম। ক্যারিয়ারে চূড়ান্ত সফলতায় পৌঁছেছিলেন উত্তম। তবে নিজের উঠে আসার পথটি ভোলেননি কোনো দিন। বাড়ির ছোটদের কাছে উত্তম ছিলেন ‘ভালো কাকু’। উত্তম মানে ভালো। সেই সূত্র ধরে ভাতিজা-ভাইঝিদের কাছে তাঁর ওই নামেই পরিচয়।

উত্তমকুমার

৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬। উত্তমকুমারের জীবনযাত্রা শুরু। পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। পড়ালেখা শেষ করার আগেই অভাব-অনটন তাঁকে কাজে নামিয়ে দিল। প্রয়োজন মেটাতে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরিও নিয়েছিলেন, চাকরি করছেন। একটু–আধটু অভিনয়েরও সাধ জাগে। আহিরীটোলায় ‘সুহৃদ সমাজ’ থিয়েটার গ্রুপে সে শখ মিটল। নিয়মিত অভিনয় করতে থাকেন। থিয়েটার করতে করতেই একদিন রুপালি পর্দার ডাক এল। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দৃষ্টিদান’। বিধি বাম। বক্স অফিসে ছবিটি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল। মহানায়ক হওয়ার দীর্ঘ পথযাত্রার শুরুটা হলো ব্যর্থতা দিয়ে।

‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমার ও শর্মিলা ঠাকুর।
ছবি: সংগৃহীত

পরপর সাতটি ছবি ব্যর্থ। নাম হয়ে গেল এফএমজি (ফ্লপ মাস্টার জেনারেল)। স্টুডিওপাড়ায় এ নামেই চিনত সবাই। অবশেষে ‘বসু পরিবার’ দিয়ে আলোর মুখ দেখলেন। আর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ তাঁকে এনে দিল খ্যাতি। এই ছবি বাংলার অমর জুটি উত্তম-সুচিত্রার প্রথম হিট ছবি।


এরপর থেকে শুধু অভিনয় আর অভিনয়। ক্রমে ‘উত্তম’ হয়ে ‘নায়ক’, অতঃপর মহানায়ক বনে যাওয়া। এই দীর্ঘ যাত্রায় কত বিচিত্র সব কাঁটা, ক্ষত, আঘাত পেরিয়ে যেতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ৬০ আর ৭০–এর দশকে অভিনয় দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির মন। ১৯২৬ থেকে ১৯৮০ সাল—৫৪ বছরের জীবনে ২১২টি ছবি উপহার দিয়েছিলেন মহানায়ক।

উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন
সংগৃহীত

উত্তমের আকর্ষণ ছুঁয়ে গিয়েছিল বিখ্যাত পরিচালকদেরও। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় উত্তমকে ভেবেই ‘নায়ক’ ছবিটি বানানোর কথা ভেবেছিলেন। ক্যারিয়ারের ১১০তম ছবিটি মুগ্ধতা এনে দিয়েছিল হলিউড থেকেও। অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর উচ্ছ্বসিত হয়ে দেখা করতে চেয়েছিলেন উত্তমের সঙ্গে।

উত্তমকুমার

অভিনয় ছাড়াও প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক এবং গায়ক হিসেবেও কাজ করেছেন মহানায়ক। ‘অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী’ ও ‘চিড়িয়াখানা’য় অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত একটি ছেলে থেকে মহানায়ক হয়ে বাঙালির হৃদয়ে চির আসন গড়ে নিলেন তিনি। অভিনয়ে চূড়ান্ত দক্ষ ছিলেন, এমনটি নয়; কিন্তু তাঁর অভিনয় দেখতে অন্ধকার হলে পর্দার দিকে বুঁদ হয়ে থাকতেন দর্শক, যা দিন শেষে একরকম জাদুবাস্তবতায় পরিণত হতো।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)