জনপ্রিয়তা নিয়ে কখনো মাতামাতি করতেন না খালেদ খান

অভিনেতা খালেদ খান
ছবি:ফেসবুক থেকে

একটি চায়ের দোকান। ক্যামেরা ধীরগতিতে এগিয়ে এসে স্থির হয় একটি মুখের ওপর। লোকটিকে চেনা যায় না। মুখের অর্ধেক অংশ দেখা যায়। চোখে তার চশমা। তিনি বসে আছেন নায়কের মতো ভাব নিয়ে। একজন চা এগিয়ে দিলে সেটি তারই গায়ের উপর ছুড়ে ফেলেন তিনি। এমনই ছিল নব্বই দশকের আলোচিত ‘রূপনগর’ ধারাবাহিক নাটকের পর্দায় খালেদ খানের উপস্থিতি। তিনি বেঁচে থাকলে আজ ৬৪ বছরে পা রাখতেন।

তার ডাকনাম যুবরাজ। তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন হইচই করে জন্মদিন উদযাপন করেছেন। দিনটি এলেই খালেদ খানের বাসায় অনেক মানুষের রান্না হতো। বন্ধুরা কেক, উপহার, ফুল নিয়ে রাত থেকে এসে বাসায় হাজির হতেন। খালেদ খান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতেন। তার স্ত্রী মিতা হক জানান, খালেদ খান খুবই মিশুক ছিলেন। তাঁর জন্মদিনটা সবার সঙ্গে কাটানোর জন্য এই দিনে কোনো শুটিং রাখতেন না তিনি। অনেক মানুষ আসতেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সে জন্য খুবই একটা বাইরেও বের হতেন না। কেউ হতাশ হোক, এটা তিনি চাইতেন না। মৃত্যুর পরে এই দিনটি তাঁদের খুব আলোড়িত করে। প্রিয় এই মানুষটাকে কীভাবে স্মরণ করছেন, জানতে চাইলে মিতা হক বলেন, ‘প্রতিবছর খালেদ খানের জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকতা থাকে। এ বছর করোনার জন্য লোকজন জড়ো করতে চাইনি। তা ছাড়া আমারও শরীর খারাপ। আমরা শুধু তার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন আছি।’

অভিনেতা খালেদ খান
ছবি: সংগৃহীত

‘রূপনগর’ ধারাবাহিক নাটকটি লিখেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ রিয়াজ উদ্দিন বাদশা। সেই নাটকে খালেদ খানের মুখে প্রথম সংলাপই ছিল ‘ছি ছি ছি ছি ছি তোমরা এত খারাপ’। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে জ্বালাবেন, সিগারেট ধার করা নিয়ে দুজনের কথা হয়। এমন সময় খালেদ খান দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনে সংলাপটি ছুড়ে দেন। নাটকে নানাভাবে সংলাপটি তার মুখে শোনা যায়। কখনো তিনি বলতেন, ‘ছি ছি ছি তুমি এত খারাপ, ‘ছি ছি ছি মাস্তান এত খারাপ’। সব কটি সংলাপ এতটা জনপ্রিয় হবে কখনো ভাবেননি এই অভিনেতা। তাঁর স্ত্রী জানালেন, অভিনয়ের সময় খালেদ খান নিয়মিত অভিনয় করে গেছেন। নিজের কাজটা মনোযোগ দিয়ে করতেন। কোনো ডায়ালগ বা নাটক, চরিত্র জনপ্রিয় হবে—সেটা তিনি কখনো ভাবেননি। এগুলো নিয়ে বাসায়ও খুব একটা কথা বলতে চাইতেন না। মিতা হক বলেন, ‘বাইরে বের হলেই তাকে সংলাপটি খুব শুনতে হতো। অনেকেই সংলাপটি নিয়ে কথা বলতেন। তিনি জনপ্রিয়তা উপভোগ করলেও কখনো মাতামাতি করতেন না। অভিনয় ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি ফোকাস করতেন না। অভিনয়ই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।’ তিনি আরও জানান, এখনো কেউ তাঁর নাম বললে একবার সেই সংলাপটি উচ্চারণ করেন। মানুষের মধ্যে এখনো যে খালেদ খানের প্রতি ভালোবাসা, তা তাঁদের মুগ্ধ করে।

রক্তকরবী নাটকে খালেদ খান ও অপি করিম
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে তাঁর জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মঞ্চনাটকে তাঁর যাত্রা শুরু। মঞ্চে তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘অচলায়তন’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘দর্পণ’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘রক্তকরবী’। ‘ঈর্ষা’ নাটকে অভিনয়ের জন্য কলকাতায়ও তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। খালেদ খান নির্দেশিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আরও রয়েছে ‘মুক্তধারা’, ‘পুতুল খেলা’, ‘কালসন্ধ্যা’, ‘স্বপ্নবাজ রূপবতী’, ‘মাস্টার বিল্ডার’, ‘ক্ষুদিত পাষাণ’সহ বেশ কিছু নাটক।

১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘সিঁড়িঘর’ নাটক দিয়ে টিভিতে অভিষেক। অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। টিভি নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘কোনো কাননের ফুল’, ‘রূপনগর’, ‘মফস্বল সংবাদ’, ‘ওথেলো এবং ওথেলো’, ‘দমন’, ‘লোহার চুড়ি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’সহ বেশ কিছু। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি নিয়ে খালেদ খান যুবরাজ ছিলেন বিরল অভিনেতা। তিনি ছিলেন অভিনয়শিল্পেরও যুবরাজ। দীর্ঘদিন ধরে মোটর নিউরন সমস্যায় ভুগে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যান খালেদ খান।

খালেদ খান ও স্ত্রী মিতা হক
ছবি: সংগৃহীত