নীতিতে অটল, মিতভাষী, পরিপূর্ণ ভদ্রলোক
![সেরাটা বের করে নিতেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F06%2F01%2Fe1d65a34d5e4a3a31c6dc67792a7b087-5ed4cc7496d2a.jpg?auto=format%2Ccompress)
মোস্তফা কামাল সৈয়দ একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক, গুণী পরিচালক, অসাধারণ একজন শিল্পী, ক্রিকেটপ্রেমী, গানের অনুরাগী, কত কী বলতে হবে! কত স্মৃতি আমাদের। আমার যত দূর মনে পড়ে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্রিকেট প্রচারের ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছে শুধু তাঁর একক প্রচেষ্টায়। অসম্ভব ক্রিকেট অনুরাগী একজন ব্যক্তি ছিলেন। এখন যে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ক্রিকেট খেলা প্রচার করতে পারছে, এটার পাইওনিয়ারও তিনি।
সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, পাগলামি ছিল অন্য রকম। তাঁর কাছে কত বৈচিত্র্যময় গানের যে সংগ্রহ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর নাটকের আবহ সংগীত শুনলে বোঝা যেত কত যত্ন করে তিনি কাজ করতেন। সংগীতের জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। ক্যামেরার পেছনের একজন মানুষ হয়েও তিনি ধ্রুবতারার মতো।
![মোস্তফা কামাল সৈয়দ। ছবি: সংগৃহীত](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F06%2F01%2F97bd83e31a83289073ff0699a5a927f6-5ed4cc74b2a9f.jpg?auto=format%2Ccompress)
আমাদের চোখের সামনেই কামাল ভাইয়ের চুল পেকে গেল, বয়স হয়ে গেল। তিনি কিন্তু দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। চাইলে খুব সহসাই ক্যামেরার সামনে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু চাননি। তিনি বলতেন, আমি প্রোডাকশনের কাজটাই মন দিয়ে করতে চাই। তবে টেলিভিশনে পেছনের মানুষ হিসেবে কাজ করলেও রেডিওতে অভিনয় করতেন।
আমরা দুজন একসঙ্গে বেশ কয়েকটা নাটকে অভিনয় করেছি। শাহবাগ থেকে রেডিও যখন আগারগাঁওয়ে ঠিকানা বদল করল, সেখানে প্রথম যে নাটকে অভিনয় করি, সেটির সহশিল্পী ছিলেন কামাল ভাই। যদিও নাটকের নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। কী যে অসাধারণ অভিনয় করতেন!
কামাল ভাইয়ের কণ্ঠ ছিল কী যে দারুণ! ও রকম গলা, একদিকে রাইসুল ইসলাম আসাদের ছিল, অন্যদিকে তাঁর ছিল। টেলিভিশনে এখনো যে ‘এইসব দিনরাত্রি’ প্রচারিত হয়, নাটকের শেষে কণ্ঠস্বর, সেটি কিন্তু তাঁরই। টেলিভিশনে তখন যে কেউ কোনো নাটকের কাজ করুক, আবদুল্লাহ আল মামুন, নওয়াজীশ আলী খান, বরকতুল্লাহ—একটা ভয়েসওভারের কাজ লাগবে, মোস্তফা কামাল সৈয়দকেই সবার লাগত।
এভাবে অসুস্থ হয়ে কামাল ভাইয়ের চিরবিদায় দুঃখজনক। আমার কাছে এর চেয়ে বেশি দুঃখজনক, শেষ বিদায়ে তাঁকে আমি দেখতে পারলাম না। এই কষ্টটা আজীবন থেকে যাবে। তিনি সত্যিই একজন অ্যাচিভার। দেশের টেলিভিশনকে তিনি একটা উচ্চতর জায়গায় নিয়ে গেছেন, যত দিন বিটিভিতে ছিলেন। এনটিভিতেও তা-ই করে গেছেন। এজেন্সির দৌরাত্ম্য শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত ভালো নাটকের উদাহরণ এনটিভি, শুধু একজন মোস্তফা কামাল সৈয়দের কারণেই সম্ভব হয়েছে। অনেক ফাইটও করেছেন। আমার মনে হয়, যখন এজেন্সির চক্করে নাটক পড়ে গেল—খাইচি, গেছি, গালাগালি শুরু হলো—তিনি হজম করতে পারতেন না। তিনি খুব কষ্ট পেতেন। তিনি সবাইকে বলতেন, নাটকে পজিটিভ কিছু রাখেন। মানুষ বিনোদিতও হবে, ভাবনার জায়গাও প্রসারিত হবে। আপাদমস্তক একজন পজিটিভ মানুষ। মিতভাষী, পরিপূর্ণ ভদ্রলোক, তবে নীতিতে অটল।
![সুবর্ণা মুস্তাফা।ছবি: প্রথম আলো](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F06%2F01%2Fbcc6fd043e6157497a9de4dc9bc71025-5ed4cd3697f80.jpg?auto=format%2Ccompress)
তাঁর কোনো তুলনা চলে না। তিনি তিনিই। অনেক নতুন পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীর বড় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। আমি দেখলাম, পরিচালক অঞ্জন আইচ লিখেছেন, ‘আমাকে যে দু-চারজন মানুষ চেনে, তার পুরো অবদানে মোস্তফা কামাল সৈয়দ।’ মমকে নাকি বলেছিলেন, ‘তোমাকে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হতে হবে।’ এগুলো তো জ্ঞানের কথা। এমন জ্ঞান কয়জনেরই-বা থাকে। কতজনই-বা এভাবে বলতে পারেন!
আমার মা-বাবার সঙ্গে কামাল ভাইয়ের আলাপ ছিল। প্রথম দেখা হয়েছিল বিটিভিতে ‘বরফ গলা নদী’ নাটকের শুটিং করতে গিয়ে। আফজাল ও আমার যতগুলো ভালো নাটক আছে, ‘নিলয় না জানি’, ‘বন্ধু আমার’, ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’ কামাল ভাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তখন একটা টিমের মতো ছিলাম। মমতাজ স্যার লিখতেন, কামাল ভাই বানাতেন। মুনিরা ইউসুফ মেমীর প্রথম নাটক ছিল তাঁরই। কখনোই নতুন শিল্পীদের চাপ দিতেন না। উৎসাহ দিতেন। কীভাবে যেন সেরাটা বের করে নিতেন।