সেটাই আব্বাকে বলা আমার শেষ ঈদ মোবারক
অন্য দিনগুলো থেকে নানা দিক দিয়ে দিনটা বিশেষ হয় বলে ঈদ আনন্দের। ঈদে অনুভূতি একেক বয়সে একেক রকমের। অভিনেত্রী অপি করিম প্রথম আলোর জন্য লিখলেন তাঁর জীবনে ঈদের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি।
ছোটবেলায় একটা ঈদ। আমরা সবাই মিলে কুমিল্লায়, আমার নানিবাড়িতে। তখন বাড়িটি হয়ে উঠত চাঁদের হাট। প্রতিবেশীরা আদর করে আমাকে সকাল সন্ধ্যা ধারাবাহিকের 'পারুলি' বলে ডাকতেন। ছোট ছিলাম, তাই আম্মা একা বাইরে যেতে নিষেধ করতেন। একবার আমি শুনিনি। তো ঈদের জামা পরে নানাবাড়ির সামনের ডোবায় পড়লাম উল্টে, পড়েই মনে হলো কচ্ছপের পিঠে পড়েছি। এখনো বুঝি না, সেটা আদৌ কি কচ্ছপ ছিল? তবে আম্মার নিষেধ অমান্য করে জীবনে যতবার যা করেছি, ততবারই হোঁচট খেয়েছি, ওই দিন থেকে যার শুরু।
দেশের বাইরে থেকে কাজল মামা এলে ঈদের সময় কুমিল্লার বিভিন্ন বাসায় নিয়ে যেতেন। শিশুশিল্পী ছিলাম তো, বাসায় বাসায় চলত ফটোসেশন। সেদিন মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, ছবিগুলো তাঁদের কাছে আছে কি না। তিনি বললেন, 'নাহ্, ছবিগুলো নেই, হারিয়ে গেছে।' এসব সেই ১৯৮৮-৮৯ সালের কথা। কুমিল্লায় ওইটাই ছিল আমার শেষ ঈদ।
পরিবার আর ঈদ
আমার ঈদ ছিল পুরোপুরি পরিবারকেন্দ্রিক। স্কুল-কলেজে আমার বন্ধু ছিল না। বন্ধু বলতে ছিল মা। তখন থাকতাম তাজমহল রোডে-বড় খালা চারতলায়, বড় মামা তিনতলায় আর দোতলায় আমরা! নিচে নানি-নানা, ছোট মামা, খালা! বাসার সামনে ছিল মসজিদ, সঙ্গে কবরস্থান, তারপর মাঠ। সেই মাঠে হতো ঈদের জামাত।
ঈদের দিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই ভিড়ে আব্বা ও ছোট ভাইকে খুঁজতাম। প্রায় সবাই সাদা পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজ পড়ছে, একসঙ্গে রুকুতে যাচ্ছে, সিজদায়..! কী যে সুন্দর লাগত!
সেমাই আর সালামি ছিল ঈদের প্রধান আকর্ষণ! ২ থেকে ২০ টাকা, সালামি বেড়েছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, আব্বাই দিতেন সবচেয়ে বেশি! আমার সব টাকা সব সময় আম্মার হাতে তুলে দিতাম, এমনকি বড় হয়েও। ঈদের পরদিন সবার সালামি জমিয়ে ১২-১৩ জন খালাতো-মামাতো ভাইবোন ৪-৫টা রিকশায় চেপে চায়নিজ খেতে যেতাম। বড়রা কেউ নেই, আমাদের কাছে ওইটাই ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
ঈদ দেশে-বিদেশে
ভর্তি হলাম বুয়েটে। নাটকও করছি পুরোদমে। প্রচণ্ড ব্যস্ত। আমার কাছে তখন ঈদের মানেই পাল্টে গেল-ঈদ মানে ঘুম। দুই দিন আয়েশ করে ঘুমাতাম। আর ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে ঈদসংখ্যা পড়তাম। আব্বা আমার জন্য সব ঈদসংখ্যা গুছিয়ে রাখতেন। আবার ঈদের ওই তিন দিনে দেখা যেত পেটমোটা একটা বইও শেষ করে ফেলেছি।
কাজে বা বেড়াতে দেশের বাইরে কয়েকটি ঈদ কেটেছে আমার। ২০০৫-এ নিউইয়র্কে নিঝু খালা ঈদের দিনও আমাকে নিয়ে লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দিলেন! তখন কেন জানি বিদেশে কারও বাসায় যেতে ভালো লাগত না, তার চেয়ে মনে হতো ঘুমাই বা ঘুরি। বাইরে কাটানো ঈদের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে ২০০৮ সালের জার্মানিতে করা ঈদের কথা।
জার্মানির বাউহাউসে পড়ছি, ঈদের আগের দিন ক্লাস থেকে পাসপোর্ট গেল হারিয়ে। এখন কী করি! মাথা ঠান্ডা রাখতে ঈদের জামা পরে বিরাট বিরাট সাইজের পেপার বিনের ভেতর ঢুকে পাসপোর্ট খুঁজতে থাকলাম ঈদের গোটা দিন।
২০০৯-এ এক ঈদে গেলাম নাগাসাকিতে। 'নাগাসাকি ন্যাশনাল পিস মেমোরিয়াল হল ফর দ্য অ্যাটমিক বম্ব ভিকটিমস' দেখতে গেলাম। ওহ্, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বীভৎসতার ছবি দেখে ট্রেনে ফিরতে ফিরতে মনে হলো, সবকিছু অন্ধকার। এটা সভ্যতা? মনে হলো, আমি তো মানুষ! সভ্যতারই অংশ। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কালো ঈদ।
ঈদ আর আব্বা
২০১৭-তে আমি আর আব্বা হজে যাই। ওইবারই প্রথম আমার মনে হলো, আমি মা, আমি একটা দুষ্টু সন্তান নিয়ে এসেছি। মক্কায়-মদিনায় ভিড়ের মধ্যে আমি আর আব্বা কত ঘুরেছি হাত ধরে! এটা নিশ্চয় আমার জীবনের অন্যতম সেরা ঈদ।
এরপর কত ঈদের কথা মনে পড়ে! মনে পড়ে আর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আব্বাকে মনে পড়ে। প্রতি ঈদে আমার হাসিমুখ দেখার জন্য উদ্গ্রীব থাকতেন তিনি। এই তো গেল বছর করোনার ভেতরে কোরবানি ঈদের দিনে আমি আর আমার দাম্পত্যসঙ্গী গাড়ি করে আম্মার বাসায় গিয়েছিলাম। আব্বা-আম্মা নিচে নেমেছিলেন। গাড়ি থেকেই দেখা করলাম, কথা বললাম। না, বাড়ির ভেতরেও যাওয়া হয়নি। সেটাই আব্বাকে বলা আমার শেষ ঈদ মোবারক।
এবারের ঈদটা আমার জন্য অন্য রকম। কারণ, আমার সঙ্গে আমার কন্যা রশ্মি প্রথমবার ঈদ করবে। ওর এবার প্রথম ঈদ।