’৭০ এর নির্বাচনে আমি সর্বকনিষ্ঠ এমপি হতে পারতাম’

অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী
ছবি: মনজুরুল আলম

দুবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। এ তথ্য নিজেই জানালেন প্রবীণ অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী। তাঁর তথ্যমতে, দেশের সর্বকনিষ্ঠ এমপি হওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু অভিনয় করবেন বলে সেদিকে পা বাড়াননি অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী। প্রায় ৪ দশকের অভিনয় ক্যারিয়ার এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বললেন তিনি।

প্রশ্ন :

অনেক দিন পরে অভিনয়ে ফিরলেন, এখন কি নিয়মিত শুটিংয়ে অংশ নেবেন?

করোনার যে অবস্থা, তাতে এখন শুটিংয়ে অংশ নিতে চাইছি না। আগে অনেক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন অনেকেই অনুরোধ করেন কাজ করতে। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়ে শর্ত দিই, সেসব শর্ত পূরণ হলেই নিয়মিত কাজ করব। আসলে বাঁচার জন্যও কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের তো আলাদা কোনো বেতন নেই।

প্রশ্ন :

শুটিং ইউনিটে নিরাপত্তা বা পরিবেশ কেমন?

শুটিং বাড়ির মালিকেরা বাসাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঠিকমতো করান না। যাঁরা শুটিং করছেন, তাঁরাও অনেকে সচেতন না। কারণ একটু বলে দিলেই তো শুটিং হাউস কর্তৃপক্ষ এবং টিম সচেতন থাকে। তা ছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা মুশকিল হয়ে যায়।

অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী
ছবি: মনজুরুল আলম

প্রশ্ন :

টেলিভিশন অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য সরকারি অনুদান চাওয়া হয়েছে, এটা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

এটা যৌক্তিক। যাঁরা দুস্থ, অসুস্থ এবং বার্ধক্যে ভুগছেন, তাঁরা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁদের সাহায্য করা জরুরি। পাশাপাশি এটাকে সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে দেখলেও ভালো হতো। সিনিয়র-জুনিয়র মিলে তিনটা গ্রুপে ভাগ করে সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এটাকে একটা পেনশন সিস্টেম হিসেবে দেখলে শিল্পীদের সম্মানটা বজায় থাকে।

অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী
ছবি: মনজুরুল আলম

প্রশ্ন :

নাটক থেকে দিন দিন পরিবারের সদস্যদের ছেঁটে ফেলা হচ্ছে, এটা নিয়ে কী বলবেন?

নাটকে পরিবার ফেরাতে কোটি কোটি টাকা দরকার নেই। দরকার আধুনিক মানসিকতা, স্বচ্ছ চিন্তা ও চেতনা। তাহলেই নাটকে ফিরে আসবে জীবনের প্রতিচ্ছবি। মা-বাবা, ভাই-বোনকে নাটক থেকে বাদ দেওয়া অন্যায় হবে। টাকার জন্য সন্তানতুল্য নাটককে আঘাত করা যাবে না। এটা যারা করছে, তারা স্বৈরতান্ত্রিকভাবে সামাজিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমাদের পাশের দেশেও বারো আনা নাটকে পুরো পরিবার থাকে। তাদের পরিবার নিয়ে ন্যূনতম জ্ঞান আছে।

প্রশ্ন :

চরিত্র পছন্দ না হলে আপনি অভিনয় করেন না, কখনো কি মনে হয়েছে নিয়মিত পর্দায় থাকার দরকার ছিল?

এখনো কিছু ছাড় দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু আজ থেকে ২০ বছর আগে হলে আমি এই গল্পগুলোতে অভিনয় করতাম না। আমি বিশ্ব নাটক নিয়ে যা লালন করি, সেটাই আগে করেছি। মাঝেমধ্যে অর্থনৈতিক কারণে মনে হয় নিয়মিত পর্দায় থাকা দরকার ছিল।

‘এই পাত্রী আমার’ নাটকের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন আমিরুল হক চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

অভিনয়ে ছাড় দিতে গিয়ে কি কখনো মনে হয়েছে, অভিনয় পেশায় না আসলেই পারতেন?

না, এটা মনে হয়নি। কারণ আমি অনেক কিছু ত্যাগ করে অভিনয়ে এসেছি। সেখানে আর্থিক অনেক সুবিধা জড়িত ছিল। সেসব আমাকে টানেনি। নাটক আমি জীবন দিয়ে করেছি। নাটক আমার প্রিয় বন্ধু প্রিয় আত্মীয়, আমার সব।

প্রশ্ন :

অভিনয় ছাড়া আর কি ধরনের সুযোগ ছিল সামনে?

আমি ঈশ্বরদী কলেজে পড়ার সময় ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলাম। সেটা মুক্তিযুদ্ধের আগে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে আমরা সামনের সারিতে ছিলাম। পরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আমাকে পাকশীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছিলেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা ছিল। সেই সময়ে আমাকে দল থেকে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। ৭০-এর নির্বাচনে আমি সর্বকনিষ্ঠ এমপি হতে পারতাম। আমার বিপরীতে কোনো প্রার্থী ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অন্য পার্টির লোকেরা আমাকে নির্বাচন করার কথা বলা বলেছিলেন, আমি মুখের ওপর না করে দিয়েছিলাম। আমি একটিই কাজ ভালো করে করতে চেয়েছিলাম, সেটা নাট্যচর্চা। অভিনয়।

২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ব্রেক শেরম্যান আমাকে তাঁর হলিউড অফিসে ডেকে নেন।
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

শুনলাম আপনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি পুরস্কার পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ। ২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ব্রেক শেরম্যান আমাকে তাঁর হলিউড অফিসে ডেকে নেন। আমার সব নাট্য কর্মকাণ্ড মনিটরিং করে তিনি পুরস্কারটি দেন। পুরস্কারটি পেয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আমি কোনো সিন্ডিকেটের সদস্য না হওয়ায় এটা সেভাবে দেশে প্রকাশ পায়নি।

প্রশ্ন :

‘চাকা’ ছবির পরে আর সেভাবে ছবি করেননি কেন?

‘চাকা’র পরে ‘নিরন্তর’ ছবিটি করেছি। তবে সংখ্যায় অনেক না। পরে কিছু চিত্রনাট্য পেয়েছিলাম কিন্তু পছন্দ হয়নি। তা ছাড়া আমি কখনো কাজের জন্য কাউকে ধরি না। কারও সঙ্গে মেকি আত্মীয়তা আমাকে দিয়ে হয় না। হলে হয়তো আমার ছবির সংখ্যা বাড়ত।

পুরস্কারটি পেয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম।
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

শেষ করার আগে পুরোনো কথাটাই জানতে চাই। আপনার অভিনয়ে কীভাবে আসা?

আমি একবার স্কাউটিং করতে পাহাড়পুরে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার শিক্ষক বললেন, তোমাকে ক্যাম্প ফায়ার অনুষ্ঠানে একটা অভিনয় করে দেখাতে হবে। একজন অসুস্থ মানুষকে কোলে তুলে সাহায্য করতে হবে। সেটি করতে গিয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলজীবন থেকে সেই আমার অভিনয়ের শুরু। পরে কলেজে পড়ার সময় পাকশী মঞ্চে নাটক করেছি। এভাবেই অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসার শুরু।

স্কাউটিং করতে পাহাড়পুরে গিয়েই অভিনয়ে পা রাখেন
ছবি: সংগৃহীত