সীমানার জীবনের শেষ ১৪ দিন...
২০০৬ সালে রিয়েলিটি শো লাক্স–চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা দিয়ে বিনোদন অঙ্গনে পথচলা শুরু রিশতা লাবনী সীমানার। এরপর অভিনয় ও মডেলিংয়ে ছিলেন নিয়মিত। ২০১৪ সালে গায়ক পারভেজ সাজ্জাদকে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার পর অভিনয়ে কম পাওয়া যায় তাঁকে। দুই সন্তান শ্রেষ্ঠ (৮) ও স্বর্গ (৩)–এর মা সীমানা অভিনয়ে ফেরার তাড়না অনুভব করতে থাকেন।
গত বছর থেকে আবার অভিনয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন। ফেরার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন পরিচিত নির্মাতাদেরও। ১৬ বছর পর ‘রোশনী’ নামের একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য হঠাৎ খবরেও এসেছিলেন তিনি। সীমানার খোঁজখবর হঠাৎ সামনে আসে। তবে অভিনয় কিংবা মডেলিংয়ের কারণে নয়, অসুস্থতার খবরে সবাই তাঁর খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। তত দিনে কথা বলার মতো শক্তি হারান। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী, চিনতেও পারছিলেন না কাউকে। এভাবেই চলে টানা ১৪ দিন। অবশেষে আজ মঙ্গলবার ভোরে পৃথিবীর সামীনা ছাড়িয়েছেন মডেল ও অভিনেত্রী সীমানা।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। লিভারে ছোট্ট একটা সমস্যা ছাড়া শারীরিকভাবে তেমন কোনো জটিলতা ছিল না সীমানার। তবে তিন বছর বয়সী ছোট সন্তান স্বর্গকে নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। গায়ক পারভেজ সাজ্জাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করলেও ছোট ছেলের জন্য চিন্তিত থাকতেন।
এক বছর ধরে মা–বাবার সঙ্গে ঢাকার মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিংয়ে থাকতেন, পারিবারিকভাবে তেমনটাই জানা গেছে। এর মধ্যে হঠাৎ গত ২১ মে রাতে মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিংয়ের বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন সীমানা। সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে দ্রুত ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে জানতে পারেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকেই আর কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেননি সীমানা। কাউকে চেনার মতো অবস্থাও ছিল না তাঁর। পরদিন উন্নত চিকিৎসার জন্য সীমানাকে ধানমন্ডির আরেকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিস্থিতির কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি না দেখে ২২ মে বিকেলে তাঁকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে ২৮ মে পর্যন্ত চলে তাঁর চিকিৎসা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মস্তিষ্কের সমস্যার পাশাপাশি কিডনির জটিলতা ধরা পড়ে।
এদিকে ২৭ মে মস্তিষ্কে একটি অস্ত্রোপচার করানো হয়। তবে পরিবারকে জানানো হয়, এই অস্ত্রোপচারে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতির আশা করা যাবে ১ ভাগ! শেষ পর্যন্ত এতেও কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। টানা সাত দিন এই হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় ছিলেন সীমানা। একপলকের জন্যও জ্ঞান ফেরেনি।
এদিকে ২৯ মে থেকে সীমানার চিকিৎসা চলে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তত দিনে পরিবারও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। হাসপাতাল বদলের আগে প্রথম আলোকে সীমানার বাবা জানান, তাঁরা ভালো নেই। তাঁর মেয়ে ভালো নেই। তাঁদের প্রচুর টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সবাই তাঁদের জন্য যেন দোয়া করে।
সীমানার মা–বাবা তাঁদের সন্তানের চিন্তায় যেমন অস্থির হতে থাকেন, তেমনি সীমানার বড় ছেলেও মাকে দেখার জন্য চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকে। বড় সন্তানের চিৎকারে সীমানার পরিবারের সবাই তাকে সামলাতে হিমশিম খান।
১ জুন সীমানার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। পরিবার বেঁচে থাকার আশা একরকম ছেড়ে দেন। চিকিৎসকদের কাছ থেকে সেভাবে কোনো আশার বাণী শুনতেও পারেননি সীমানার পরিবারের কেউই। ছোট ভাই এজাজ বিন আলী জানান, এদিন তাঁদেরকে জানানো হয়, মস্তিষ্কের একটি সিটি স্ক্যান করাতে।
প্রতিবেদন দেখার পর ১২তম দিনে চিকিৎসকের বরাতে এজাজ বিন আলী জানান, ‘চিকিৎসকেরা আমাদের জানিয়েছেন, আপুর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ব্রেনের একটা সিটি স্ক্যান করতে বলেছেন। এই পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলেই তাঁরা আমাদের পরবর্তী করণীয় কী, জানাবেন। তবে যা বুঝতেছি, পরিস্থিতি মোটেও ভালো কিছু নয়। আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি। অলৌকিক যদি কিছু ঘটে, তাহলে হয়তো আপু সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
১৩তম দিনেও কোনো উন্নতি হয়নি। সীমানার ছোট ভাই জানান, যতই দিন যাচ্ছে, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে। চিকিৎসকেরাও তাঁদের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কথা প্রসঙ্গে এজাজ বিন আলী জানান, ‘আমরা আসলে অপেক্ষা করছি, কখন ঘোষণা আসবে। আপুর এই অবস্থা আমরা কেউ সহ্য করতে পারছি না। আব্বু-আম্মু ও আপুর বড় ছেলের দিকে তাকাতে পারছি না। শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে আজ সকাল ছয়টায় চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’
এর মধ্য দিয়ে সীমানা তাঁর জীবনের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে যায় মৃত্যুর সীমানায়। এরপর তিনি শুধু স্মৃতি হয়ে থাকবেন। বেলা তিনটার দিকে যখন পরিবারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন সীমানার মরদেহবাহী গাড়িটি শেরপুরের নকলা উপজেলার দিকে যাচ্ছিল। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে তাঁকে।