স্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত, সংকটের সময় ৩৪ লাখ টাকার পাওনা পাননি ডলি জহুর

ডলি জহুরসংগৃহীত ছবি

আশির দশকের শুরু থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন ডলি জহুর। টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এরপর একদিন রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে সিনেমায় অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন। ফিরেও তাকাননি বড় পর্দার দিকে। তবে ছোট পর্দায় এখনো কাজ করে চলছেন তিনি। স্বামী ক্যানসার আক্রান্তের সময় প্রাপ্য বকেয়া সম্মানী সবার কাছে চেয়েও যখন পাননি, তখনই সিনেমাকে ‘গুডবাই’ জানান বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পী।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে এই ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন ডলি জহুর। ৩ দশকের চলচ্চিত্র অভিনয়জীবনে ডলি জহুর অভিনীত সিনেমার সংখ্যা ১৬১। প্রথম ছবির নাম ‘অসাধারণ’, রহীম নওয়াজ পরিচালিত ছবিটিতে আরও অভিনয় করেন রাজ্জাক, ববিতা, প্রবীর মিত্র, সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখ। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা ‘দুই পৃথিবী’, এফ আই মানিক পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেন মান্না, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস ও অহনা প্রমুখ।

দীর্ঘ সময়ের অভিনয়জীবনে সম্মানীর টাকা বকেয়া হতে হতে ৩৪ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১০ সালের দিকে স্বামীর ক্যানসার আক্রান্তের খবর শোনার পর সবার কাছে পাওনা টাকা চান তিনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই সময়টায় পাওনা টাকার দেখা পাননি ডলি জহুর। এই ক্ষোভ ও দুঃখ থেকে সিনেমায় অভিনয়কে বিদায় জানান বলে জানালেন তিনি।

ডলি জহুর
ফাইল ছবি

প্রথম আলোকে ডলি জহুর বললেন, ‘আমার সময় নষ্ট হবে, কাজ করব কিন্তু পয়সা পাব না। আমি তো সবাইকে জোরও করতে পারি না। একজন অভিনয়শিল্পী তো পাওনা আদায়ে জোর করতে পারে না। আমার কোনো সেক্রেটারি ছিল না, আমার স্বামীকেও টাকা তুলে আনতে পাওনাদারের কাছে পাঠাতে পারব না—এ রকম আরকি ব্যাপারটা। যার কারণে যখন আমি দেখলাম, টাকাটা আদায় করতে যেহেতু পারি না, থাক, দরকার নেই, আমিই বরং আর কাজ করব না। আমার টাকায় যদি কেউ বড় হয়ে যায়, হোক বড়। আল্লাহ তাদের কপালে যা রাখছেন, আমার টাকা দিয়ে বড় হওয়ার, হোক। কিন্তু পরে দেখলাম, কেউ বড় হতে পারেনি, সবাই এখন সেই টানাপোড়েনেই আছে, আমার পাওনা যারা দেয়নি, তাদের অবস্থা মোটেও ভালো না। তাদের প্রতি আমার করুণাই হয়, মায়া হয়। কারণ, আমি এখন চাইতে পারব না, কারণ চাইতে গেলেও তাদের কাছে পাব না, তাদের তো আরও খারাপ অবস্থা এখন, তাই না?’

ডলি জহুর জানালেন, হয়তো পাওনা টাকাগুলো তখনো চাওয়া হতো না, আমার স্বামীর যদি ক্যানসার ধরা না পড়ত, তাহলে এমন পরিস্থিতিতেও আমাকে পড়তে হতো না। বললেন, ‘যখন শুনলাম, আমার স্বামীর ক্যানসার, আমার তখন তো ভয়ানক অবস্থা। হাতে টাকাপয়সা নেই। কারণ, আমি ব্যবসা করি না, অভিনয়টাই শুধু করি। সাহেবের যে ব্যবসাটা, সেটার কী অবস্থা, তা–ও আমি জানতাম না। দুরবস্থার মধ্যে আমি কোথা থেকে টাকা পাব, তাই না? আমাদের তো সব ঠিকঠাক চলছিল, কোনো টানাপোড়েন ছিল না, কাজ করেছি, জীবন যাপন করেছি। আমি কখনো ওর ব্যাপারে যেমন চিন্তা করতাম না, ওর ব্যবসায় কী হচ্ছে, অবস্থা কী, কখনো সমস্যা হচ্ছে কি না—এ নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। যার যার মতো করে কাজ করতাম। আর একটামাত্র ছেলে পড়াশোনা করছে, সবই তো ঠিক আছে।

কথা প্রসঙ্গে ডলি জহুর বললেন, ‘২০১০ সালের দিকে যখন পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে জানতে পারলাম, জহুরের ক্যানসার, তা–ও ফোর্থ স্টেজ, তখন তো আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। আমার কাঁপুনি আর কে দেখে। তখন আমি কার কাছে টাকা চাইব? চিন্তা করে দেখলাম, আমি তো অনেকের কাছে টাকাপয়সা পাই, তাহলে বলি না কেন? যার পুরো সিনেমাটা শেষ করলাম, মুক্তিও দিল, অথচ আমাকে একটা পয়সাও দিল না। এমনটা অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। তখন এত ব্যস্ত থাকতাম, এই সেট থেকে ওই সেটে, ওই সেট থেকে সেই সেটে, এখান থেকে সেখানে, ঢাকা থেকে পুবাইল—এ রকম কাজ করতাম। টাকা জোর করে চাইব বা কারও অফিসে যাব—এমনটা কখনো ভাবতে পারি না। আমি এই জীবনে কোনো দিন কোনো প্রোডাকশন অফিসে জীবনেও যাইনি। যেতে পারিনি আরকি। যা দিত, তাই ব্যস, এই আরকি।’

ডলি জহুর
ছবি : প্রথম আলো

ডলি জহুর বলেন, তাঁর হিসাবে ২০১১ সালে যখন সিনেমায় অভিনয়কে বিদায় জানান, তখন প্রযোজক–পরিচালকের কাছে তাঁর পাওনা ছিল ৩৪ লাখ টাকা। এর সব হিসাব তাঁর কাছে এখনো আছে—কে কত দিয়েছে, দেয়নি, সব হিসাব। ডলি জহুর বললেন, ‘আমি এখন আর এসব নিয়ে একদম চিন্তাভাবনা করি না। কারণ, ভেবে তো লাভ নাই। ওদের কাছ থেকে এখন তো ৩৪ টাকাও পাওয়া সম্ভব না।’

১৯৭৬ সালে জহুরুল ইসলামকে বিয়ে করেন ডলি জহুর। এরপর চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন তিনি। ডলি জহুরের একমাত্র ছেলে পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকেন, সেখানে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন বলে জানালেন এই অভিনয়শিল্পী। ২০০৫ সাল থেকে ডলি জহুর ঢাকার উত্তরায় থাকেন। সেই ২০১১ সাল থেকে সিনেমায় অভিনয়কে গুডবাই জানিয়ে দেওয়ার পর অনেক প্রযোজক–পরিচালক তাঁর উত্তরার বাসায়ও গিয়েছেন। তবে দেখা করতে পারেননি। কারও প্রস্তাবে তিনি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য রাজি হননি।

আরও পড়ুন

সেই সময়ের কথা মনে করে ডলি জহুর বললেন, ‘অনেকে আমার বাসা পর্যন্ত এসেছে। আমি সবাইকে চলে যেতে বলতাম। বাসার ওপর থেকে এ–ও বলতাম, ‘দেখো, যদি না যাও, তাহলে কিন্তু দারোয়ান দিয়ে তোমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব। কারণ, আমি সবার প্রতি অনেকটাই বিরক্ত ছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে সংকটের দিনে আমি ওদের কারও কাছ থেকে পাওনা টাকা পাইনি, এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে!’