মোশাররফ করিমকে যে কথা গর্বের সঙ্গে জানাতে চেয়েছিলেন প্রয়াত অভিনেতা রুমি

‘যমজ’ নাটকের শুটিংয়ের দৃশ্যে অভিনেতা রুমি ও মোশাররফ করিম। ছবি: সংগৃহীত

গত ২৫ জানুয়ারির কথা। হঠাৎই অভিনেতা রাশেদ সীমান্তের মুঠোফোনে কল আসে। ওপাশ থেকে অভিনেতা অলিউল হক রুমি বলেন, ‘আমি একটু অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে একটা রিপোর্ট দিছে। বলতেছে ক্যানসার। তুই একটু দেখে দিবি।’ শুনেই চমকে ওঠেন এ অভিনেতা। সঙ্গে সঙ্গে চলে যান মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে। পরিচিত চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সেই রিপোর্ট দেখে বলে দেন এই অভিনেতার শারীরিক অবস্থা ভালো নেই। ক্যানসার শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আর খুব বেশি দিন বাঁচবেন না।

এমন খবরেও সদ্য প্রয়াত এই অভিনেতা খুব বেশি ঘাবড়ে যাননি। তিনি মনে করেছিলেন, ক্যানসার থেকে দ্রুত সেরে উঠবেন। সে সময় অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে শুধু এই ক্যানসারের কথা জানতেন অভিনেতা রাশেদ সীমান্ত। এই অভিনেতা বলেন, ‘আমি ভাইয়ের সঙ্গে সেদিন কথা বলার পরে দেখলাম, ভাই মনোবল হারাননি। তাঁকে দ্রুত ভারতে চিকিৎসা করানোর কথা বলি। পরে সব ব্যবস্থা করা হয়। ভাইয়ের খুবই কাছে ও পছন্দের অভিনেতা ছিলেন মোশাররফ করিম ভাই। রুমি ভাই তখন ভাবছিলেন মোশাররফ করিম ভাইকে ক্যানসারের কথা জানাবেন কি না। পরে তিনি সেদিন জানাতে চাননি। তিনি আর কাউকেই ক্যানসারের কথা বলতে চাননি। এর কারণ, রুমি ভাই চেয়েছিলেন গর্ব করে সবাইকে বলবেন, তিনি ক্যানসার জয় করেছেন। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন, ক্যানসার হলেও ফেরা যায়। কিন্তু শেষ সময়ে ধরা পড়ায় সেটা আর হলো না।’

অভিনেতা রুমি ও রাশেদ সীমান্ত। ছবি: ফেসবুক

পরে এই অভিনেতা চিকিৎসা করাতে ভারতে যান। সেখানে সব রকম শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে চিকিৎসক বলে দেন, বড়জোর তিনি ছয় মাস বাঁচবেন। সেই সময় দেরি না করে অভিনেতা রুমি দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। তিনি মনে করতেন দেশে ফিরে বাসায় চিকিৎসা নিলেই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থা দিন দিন আরও বেশি খারাপ হতে থাকে। কাছের মানুষগুলোকে তাঁর ক্যানসারের কথা জানানো হয়।

রাশেদ সীমান্ত বলেন, ‘আমার ক্যারিয়ারের প্রথম নাটকের দিন, শুটিংয়ের পর তিনি ক্যামেরা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমাকে সাহস দিয়েছিলেন অভিনয় করে যেতে। সেই থেকে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাকে সব সময় ছোট ভাইয়ের মতো করে দেখতেন। আমাদের সম্পর্কটা ছিল পারিবারিক। প্রতিদিন কথা হতো। আমাদের বাসায় যাওয়া হতো। রুমি ভাই সব সময় মাতিয়ে রাখতেন। ভারত থেকে আসার পর চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছিলেন খুব বেশি কথা না বলতে। তাহলে আরও দ্রুত মারা যাবেন। এমন হয়েছে ভাইকে দেখতে গিয়ে কথা বলা হয়নি। কিন্তু তিনি একটা কথাই বলতেন সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

গত মাস থেকে অভিনেতা রুমির মধ্যে শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। নিয়মিত তাঁর ওজন কমতে শুরু করে। একসময় তাঁর অক্সিজেন কমতে থাকে। তখনো তাঁর ইচ্ছা ছিল সম্প্রতি প্রচার হওয়া নাটক ‘হাবু’ সিরিজের শুটিং করা। একসময় বুঝতে পারেন শুটিং আর করা হবে না। সীমান্ত জানান, অভিনেতা রুমি নিয়মিত শুটিংয়ে হাজির হতেন। দীর্ঘ তিন দশকের ক্যারিয়ারে তাঁকে পছন্দের অনেক চরিত্রে দেখা গেলেও অভিনয় নিয়ে তাঁর মধ্যে আক্ষেপ ছিল।

রুমি ও মোশাররফ করিম
ফেসবুক থেকে

গত বছর শেষের দিকে অভিনেতা রুমি মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বৈশাখী টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার অভিনয়ের যে দক্ষতা, সেখানে আমাকে সেই অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আমি আরও ভালো চরিত্র, গল্প ডিজার্ব করি। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আমার কোনো পুরস্কার নেই। কিন্তু কম অভিনয়দক্ষতা নিয়েও অনেকেই পাচ্ছে। এটা খারাপ লাগে। তবে সর্বশেষ “হাবুর স্কলারশিপ” ধারাবাহিক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।’

সেই ধারাবাহিক নিয়ে আরও বড় করে পরিকল্পনা করেছিলেন রাশেদ সীমান্ত। তিনি বলেন, ‘রুমি ভাই এখানে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষক। যে প্রত্যন্ত গ্রামের এক শিক্ষক হয়ে তার ছাত্রকে স্কলারশিপ পাইয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠায়। তার ওপর ছিল গল্প। কমেডির বাইরে এই নাটক থেকে তিনি অনেক প্রশংসা পেয়েছিলেন। এটা তাঁর পছন্দের চরিত্র ছিল। আমাদের চিন্তা ছিল তানজিকা, মৌসুমী, রুমি ভাই সবাই স্কলারশিপ পাওয়ার পর ঘটনা নিয়ে এবার অস্ট্রেলিয়ায় শুটিংয়ে যাব। ভিসাও করা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু রুমি ভাই আর আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না। হয়তো সেই নাটকটি আর করা হবে না।’

গতকাল লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন সীমান্ত। ছবি: ফেসবুক

বরিশালের ভাষায় ‘যমজ’ নাটকের বেশ কিছু সিকুয়েলে একসঙ্গে অভিনয় করে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পান অভিনেতা রুমি। দুজনই বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় অভিনয় করেন। নাটকের ‘দাদো’ সংলাপ ভক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, ঢাকার বাইরে থাকায় মোশাররফ করিম শেষবারের মতো দেখতে পারেননি। তবে লাশ কখন কীভাবে দাফন হচ্ছে, সেই খবর প্রতিমুহূর্তে রেখেছেন।

শুটিং থেকেই পারিবারিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের টানে দাফন পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন অভিনেতা রাশেদ। ঢাকায় ফিরেছেন গভীর রাতে। কথা বলতে গিয়ে তিনি ভেঙে পড়েন। বলতে থাকেন, ‘রক্তের সম্পর্কের চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিলেন। তিনিই আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শুটিংয়ে পাহারা দিয়ে রাখতেন। তাঁর কাছ থেকে জীবনবোধসহ অনেক কিছু শিখেছি। আগলে রাখা সেই রুমি ভাইকে আজ পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’ কথাগুলো শেষ করে কিছুটা সময় চুপ থাকেন এই অভিনেতা।

রাশেদ সীমান্ত আরও বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটা ছিল নিঃস্বার্থ। মিডিয়ার কেউ কারও কাছের হতে পারে না, এটা তাঁর ক্ষেত্রে সত্য নয়। মিডিয়ার সবাই তাঁকে পছন্দ করতেন। সহ–অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে রুমি ভাইয়ের অনেক পছন্দের মানুষ ছিলেন মোশাররফ ভাই। রুমি ভাই সব সময় বলতেন, “ও এত পরিশ্রম করে। কখন যে অসুস্থ হয়।” সেই রুমি ভাই চলে গেলেন। লাশ নিয়ে যাওয়ার পথে সেগুলো নিয়েই বারবার কথা হচ্ছিল মোশাররফ ভাইয়ের সঙ্গে। লাশ দাফন হওয়া পর্যন্ত প্রতিটা মুহূর্ত মোশাররফ ভাই খবর নিয়েছেন। এমন একজন মানুষকে হারানোটা আমাদের কাছে অনেক কষ্টের ছিল। রুমি ভাইকে সহজেই ভোলা যায় না। এমন অভিনেতা, মানুষ কালেভদ্রে আসেন। তিনি আমাদের অন্তরে থাকবেন।’

অভিনেতা রুমি। ছবি: ফেসবুক