‘আমাদের কালে সিনেমাপাগল ছিলাম’

আফজাল হোসেনছবি : দীপু মালাকার
প্রেক্ষাগৃহে নিয়মিত সিনেমা দেখেন অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক আফজাল হোসেন। সময়-সুযোগ পেলে বন্ধুবান্ধব নিয়েও যান। বাইরের দেশে গেলেও সিনেমা দেখা হয় তাঁর। ছাত্রজীবন থেকেই সিনেমা দেখার এই অভ্যাস। ১৯৭০ সালে যেদিন প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন, সেদিন বাসায় যাওয়ার আগে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়েন। শুটিংয়ের ব্যস্ততায় এবার ঈদের ছবি দেরিতেই দেখা শুরু করেছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার দলবল নিয়ে দেখলেন সিনেমা ‘দাগি’। ছবিটি তাঁকে মুগ্ধ করেছে, এ নিয়ে নিজের ভালো লাগার কথা ফেসবুকেও লিখেছেন। ঈদের সিনেমা দেখা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আফজাল হোসেন ৫৫ বছরের ঢাকার জীবনে প্রেক্ষাগৃহে বসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ফেসবুকে। গতকাল এই ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

গত শুক্রবার বিকেলে আফজাল হোসেন বলেন, একটা সময় দর্শকের মান উন্নত ছিল। তখন দর্শকেরা সবকিছু দেখতেন। কে গান লিখলেন, কে গল্প লিখলেন; বলা যায় দর্শকের প্রেম ছিল সিনেমার সঙ্গে। সিনেমা তাঁদের কাছে শুধু বিনোদন ছিল না। বিষয়টা এমন নয় যে টাকা দিয়ে টিকিট কাটলাম, সিনেমা দেখলাম, তা নয়। দর্শক সিনেমা নিয়েই মেতে থাকতেন।

আফজাল হোসেনের ভাষ্যে, ‘সারা বিশ্বে সিনেমার রূপান্তর ঘটছে। চলচ্চিত্র দিয়ে দেশের পরিচিতি তৈরি হয়। দেশের নাম ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বব‍্যাপী। আর আমরা সিনেমা দেখা, বানানো ছেড়ে দিলাম। আমাদের ঝলমলে সিনেমাজগৎটা অন্ধকারে ডুবে গেল। সৌভাগ্যের কথা হলো, অন্ধকার থেকে সিনেমা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া চক্কর, জংলি, দাগি ও ‘বরবাদ’ খুব ভালো লাগছে। ঈদের পর থেকে আজ অবধি যেখানেই যাই, এসব সিনেমা নিয়ে চর্চা হতে দেখি। এটা হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার মতো।’

আফজাল হোসেন
ছবি : কবির হোসেন

আফজাল হোসেন মনে করেন, সিনেমাকে বদলে দিতে পারেন তারকা।  তারকাকেও বদলে দিতে পারে সিনেমা।

এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে আফজাল হোসেন বলেন, ‘তারকা সিনেমার চেহারা বদলে দিতে পারেন। সিনেমাও বদলে দিতে পারে তারকাকে। শাকিব খান তার উদাহরণ। এই তারকা প্রথমে নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তারপর ক্রমাগত বদলে দিচ্ছেন তাঁর সিনেমাগুলোকে। দেশটায় আরও কয়েকজন সাহসী পরিচালক থাকলে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, সিয়াম, নিশোরা আমাদের চলচ্চিত্রের মহা আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারতেন। সিনেমার চেহারায় দারুণ পরিবর্তন নিশ্চয়ই আসতে পারত।’

‘দাগি’ নিয়ে আফজাল হোসেন লিখেছেন, ‘শিহাব শাহীনকে অতি চমৎকার নির্মাতা হিসেবে জানি, তাই আগ্রহ নিয়ে “দাগি” দেখতে যাই। নিশোকে নিয়ে আলোচনা শুনি, সে জন্যও বন্ধুবান্ধব ঠিক করে যে দাগি দেখবে। একসঙ্গে গিয়েছিলাম ৯ জন। সবাইকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। হল থেকে বেরিয়ে দলেবলে রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি। পুরো সময়টা “দাগি” নিয়ে অসংখ্য রকমের কথা হয়েছে।’

সিনেমাটি নিয়ে আফজাল হোসেন আরও লিখেছেন, ‘আমার খুব ভালো লেগেছে, আবার আগের মতোই আমাদের দেশে তৈরি একটা সিনেমা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ সবাই হইহই–রইরই আলাপ করেছি। শিহাব শাহীন মুগ্ধ করেছেন তাঁর নির্মাণের মুনশিয়ানা দিয়ে। গল্পটা এক বৈচিত্র্য থেকে আরেক বৈচিত্র্যে দৌড়ায়। থামে না। দৌড়াতেই থাকে। কী হবে এরপর, এই কৌতূহল সারাক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারা খুবই কঠিন কিন্তু সহজেই তা পেরেছেন শিহাব শাহীন।’

নিজেকে ‘সিনেমাপাগল’ উল্লেখ করে আফজাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি আমাদের কালে সিনেমাপাগল ছিলাম। বয়স বেড়েছে কিন্তু একের পর এক ভালো সিনেমা হতে থাকলে যৌবনের আনন্দ আবার ফিরে পেতে পারি, মনে হয়েছে। নতুন নতুন সিনেমা ঘর হোক, মানুষ সিনেমা দেখুক। নানা রকম গল্পের চর্চায় মানুষ নিত্য নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারুক; এ চাওয়া বাড়াবাড়ি রকমের নয়। ঈদের আনন্দের সঙ্গে বহুকাল পরে আবার সিনেমার আনন্দ যুক্ত হয়েছে। এ যেন হারিয়ে পাওয়া। মানুষ কথা বলছে “বরবাদ”, “চক্কর”, “জংলি”, “দাগি” নিয়ে। সিনেমা তো একধরনের স্বপ্ন রচনা। স্বপ্ন বড় হতে থাকলে মানুষও বড় হবে।’

আফজাল হোসেন
ছবি : জাহিদুল করিম

আফজাল জানান, তিনি এতটাই সিনেমাপাগল ছিলেন যে ঢাকায় যেদিন প্রথম পা দেন, শহর তেমন আকর্ষণ না করলেও করেছিল সিনেমা হল। ‘বলাকা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি, দর্পচূর্ণ চলছে। গ্রামের ছেলে, মফস্‌সলের সিনেমা ঘরে ছয় মাস বা এক বছরের পুরোনো সিনেমা দেখতে হতো। দর্পচূর্ণ-এর বিশালাকারের ঝলমলে ব‍্যানার দেখে নেশা চেপে গেল, আজকেই সিনেমাটা দেখতে হবে। এখনো বলাকা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যখনই যাই, আমার মন ঘুরে তাকায় বলাকার দিকে। আজও তাকিয়েছি। তাকিয়ে দেখে খুব কষ্ট হলো, কেমন সর্বস্বান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই সিনেমা ঘর।’ লিখেছেন তিনি।

ঢাকা থেকে মিরপুর দিয়ে বের হতে গেলে আফজাল হোসেন অবশ্যই ডান দিকে ঘুরে বিউটি সিনেমা হলটাকে খোঁজেন। পান না। অনেক দিন পর সেদিন হাটখোলার দিকে যেতে গিয়েছিলেন। মতিঝিল তাঁর পুরোনো স্মৃতিময় এলাকা।

আফজাল হোসেন লিখেছেন, ‘মধুমিতাকে মনে হলো প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তানের মতো। ‘বরবাদ’ চলছে বলে মানুষজনের ভিড় রয়েছে, কিন্তু সে ভিড়ে উৎসবমুখরতা নেই। আমাদের যৌবনে সিনেমা দেখাটা ছিল আনন্দ উদ্‌যাপন। অভিসার সেদিন দুঃখ দিয়েছে। মনে হলো, তার যদি দুঃখ প্রকাশের ক্ষমতা থাকত; রোজ যত মানুষ তার দিকে স্মৃতিভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাকায়, জায়গাটা শোকে, দুঃখে অঝোরে কাঁদত। গুলিস্তানের দিকে অনেক দিন যাওয়া হয় না। যেসব বন্ধুবান্ধব ওদিকে যায়টায়, তারা বলে, “যাসনে ওদিকে। গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে তাকালে মনে হবে, ইতিহাস চুরমার, স্মৃতি ধুয়েমুছে সাফ।”’

বলাকা সিনেমা হলের স্মৃতি স্মরণ করে আফজাল হোসেন আরও লিখেছেন, ‘আজ এপ্রিলের চব্বিশ তারিখ (গতকাল)। পাঁচটা পনেরোয় বলাকা অতিক্রম করেছি। ঠিক এ সময় লোক গমগম করত হলটার সামনে। টিকিট ব্ল‍্যাকার গলা তুলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত—অ‍্যাই রেয়ার, অ‍্যাই ডিসি। প্রবেশপথের মুখে হাউসফুল লেখা লাল বোর্ড ঝোলানো, তবু টিকিট কাউন্টারের সামনে হালকা ভিড় জমে থাকতে দেখেছি। সময়ের তোড়ে কত কিছু বদলে যেতে দেখলাম।’

তখন হলে কী ধরনের সিনেমা প্রদর্শিত হতো, সেটাও লিখেছেন এই অভিনেতা। তাঁর লেখায়, ‘সিনেমা প্রেক্ষাগৃহগুলোয় ইংরেজি, উর্দু ও বাংলা তিনটি ভাষার সিনেমা চলত। সব শ্রেণির দর্শক সব ভাষার সিনেমা আগ্রহ নিয়েই দেখেছেন। ইংরেজি ছবি হাউসফুল, উর্দু ছবি চলা সিনেমা হলেও টিকিট নেই। আর বাংলায় সিনেমা হয়েছে কত রকমের! সব রকমের সিনেমা দেখতে ঠ‍েলাঠেলি–ধাক্কাধাক্কি হতে দেখতাম। সব রকমের সিনেমা দেখায় আগ্রহ ছিল বলেই নির্দ্বিধায় তৈরি হয়েছে সামাজিক সিনেমা, পোশাকি বা রাজনৈতিক সিনেমা। গ্রামের গল্প, শহুরে গল্প সব রকমের সিনেমাকে উপভোগ করা মানে দর্শকের মানসিক উচ্চতা কতখানি ছিল; তা বুঝে নেওয়া যায়।’