খালেদ খানের অভাব এখনো অপূরণীয়

অভিনেতা খালেদ খান
ছবি: সংগৃহীত

মঞ্চনাটক বা টেলিভিশন—যেকোনো মাধ্যমই বলি না কেন, অভিনেতা খালেদ খানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন সহকর্মী ও ভক্তদের কাছে যুবদা। কখনো তাঁকে বলা হতো বাংলা নাটকের যুবরাজ। এই অভিনেতা ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর আজকের দিনে প্রয়াত হন। তিনি এখনো নানাভাবে উঠে আসেন ভক্ত, সহকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের লেখায় ও স্মৃতিকথায়, যা প্রকাশ করে খালেদ খানের অভাব এখনো অপূরণীয়।

একটি চায়ের দোকান। ক্যামেরা ধীরগতিতে এগিয়ে এসে স্থির হয় একটি মুখের ওপর। লোকটিকে চেনা যায় না। মুখের অর্ধেক অংশ দেখা যায়। চোখে তাঁর চশমা। তিনি বসে আছেন নায়কের মতো ভাব নিয়ে। একজন চা এগিয়ে দিলে সেটি তাঁরই গায়ের ওপর ছুড়ে ফেলেন তিনি। এমনই ছিল নব্বইয়ের দশকের আলোচিত ‘রূপনগর’ ধারাবাহিক নাটকের পর্দায় খালেদ খানের উপস্থিতি। খালেদ খানের এমন বহু নাটকের কথাই বলা যায়।

অভিনেতা খালেদ খান। ছবি: সংগৃহীত

অভিনয়ের পাশাপাশি শেষ দিনগুলোয় শিক্ষকতা নিয়েই ছিলেন খালেদ খান। এর মধ্যেই ধরা পড়ে অসুস্থতা। একসময় তিনি নিজে খেতেও পারতেন না। এ নিয়ে তাঁর মেয়ে ফারহিন খান জয়িতা এক তথ্যচিত্রে বলেছিলেন, ‘একসময় বাবা কলম দিয়ে সাইন করতে পারতেন না। এমনকি ল্যাপটপের কাজগুলোও করতে পারতেন না। আমিই সেগুলো করে দিতাম। বাবা খাতাগুলো পড়তেন, আমি পাতা উল্টো দিতাম। বাবা হাত দিয়ে পাতা উল্টাতে পারতেন না। কিন্তু মূল কাজটি বাবাই করতেন।’

পর্দায় সফলতা থাকলেও শেষ সময়ে খালেদ খান মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না। কারণ, অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন। এ নিয়ে তাঁর সহকর্মী লাকী ইনাম বলেছিলেন, ‘এত কষ্ট বুকে নিয়ে সে একটু পালিয়ে বেড়াত। আমি তার এত সিনিয়র হয়েও অভিনয় করছি, নির্দেশনায় কাজ করছি। অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। সেই কষ্ট ওর মধ্যে ছিল।’
তারপরও কোনো দিন দমে যাননি যুবরাজ। সেই সময়েও খালেদ খান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতেন। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী মিতা হক এর আগে প্রথম আলোকে জানান, খালেদ খান খুবই মিশুক ছিলেন। অনেক মানুষ আসতেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জীবন নিয়ে নানা কথা বলতেন।

অভিনেতা খালেদ খান ও মিতা হক দম্পতি
ছবি: ফেসবুক থেকে

এই অভিনেতার পরিচিতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ‘রূপনগর’ ধারাবাহিক নাটক দিয়ে। এটি লিখেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ রিয়াজ উদ্দিন বাদশা। সেই নাটকে খালেদ খানের মুখে প্রথম সংলাপই ছিল ‘ছি ছি ছি ছি ছি তোমরা এত খারাপ’। সংলাপটি এতটা জনপ্রিয় হবে, তা কখনো ভাবেননি এই অভিনেতা। তাঁর স্ত্রী জানিয়েছিলেন, অভিনয়ের সময় খালেদ খান নিয়মিত অভিনয় করে গেছেন। নিজের কাজটা মনোযোগ দিয়ে করতেন। কোনো ডায়ালগ বা নাটক, চরিত্র জনপ্রিয় হবে, সেটা তিনি কখনো ভাবেননি। এগুলো নিয়ে বাসায়ও খুব একটা কথা বলতে চাইতেন না।

মিতা হক ২০২১ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাইরে বের হলেই তাঁকে সংলাপটি খুব শুনতে হতো। অনেকেই সংলাপটি নিয়ে কথা বলতেন। তিনি জনপ্রিয়তা উপভোগ করলেও কখনো মাতামাতি করতেন না। অভিনয় ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি ফোকাস করতেন না। অভিনয়ই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। এখনো অনেকেই সেই সংলাপ উচ্চারণ করেন। মানুষের মধ্যে খালেদ খানের প্রতি ভালোবাসা, তা আমাদের মুগ্ধ করে।’

আরও পড়ুন
অভিনেতা খালেদ খান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মঞ্চনাটকে খালেদ খানের যাত্রা শুরু। আশির দশকে মঞ্চে তুমুল আলোচিত নাম ছিল খালেদ খান। তাঁর কণ্ঠ ও অভিনয় তাঁকে আলাদা করে। মঞ্চে তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘অচলায়তন’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘দর্পণ’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘রক্তকরবী’। খালেদ খান নির্দেশিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আরও রয়েছে ‘মুক্তধারা’, ‘পুতুল খেলা’, ‘কালসন্ধ্যা’, ‘স্বপ্নবাজ রূপবতী’, ‘মাস্টার বিল্ডার’, ‘ক্ষুদিত পাষাণ’সহ বেশ কিছু নাটক।

একের পর এক মঞ্চে সাড়া জাগিয়ে ১৯৮১ সাল থেকে টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন খালেদ খান। ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘সিঁড়িঘর’ নাটক দিয়ে টিভিতে অভিষেক। অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। টিভি নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘রূপনগর’, ‘মফস্বল সংবাদ’, ‘ওথেলো এবং ওথেলো’, ‘দমন’, ‘লোহার চুড়ি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’সহ বেশ কিছু। দীর্ঘদিন ধরে মোটর নিউরন সমস্যায় ভুগে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যান খালেদ খান।