বইমেলায় ফারুক আহমেদের সঙ্গে সেই ফুলি কী করছেন
বইমেলায় হঠাৎ পাওয়া গেল ফুলিকে। সঙ্গে সেই মতি মিয়া। চিনতে পেরেছেন তাঁদের? হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয় চিনে গেছেন এতক্ষণে। নাটকের গল্পে দুজনের প্রেম, মান–অভিমানের গল্প দর্শকদের বিনোদন দিয়েছিল। মূল চরিত্রের পাশাপাশি অভিনয় দিয়ে তারা রাতারাতি দর্শক মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সেই জনপ্রিয় নাটকের দুই অভিনয়শিল্পীকে একসঙ্গে পাওয়া গেল বইমেলায়।
‘ফুলির কথাই আমার কথা,’ ‘তার মতো জ্ঞানী মানুষ আমি এই জীবনে দেখি নাই গো আফা’, ‘আজই একটা বিরাট ফাটাফাটি হইব’, ‘সত্য কথা দিনের মধ্যে চৌদ্দবার বলা যায়’—তাঁদের মুখে নাটকের এমন অনেক সংলাপ জনপ্রিয় হয়। সেই সময় ফুলি চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিত পেয়েছিলেন নাসরিন নাহার। পরে অবশ্য অভিনয়ে তাঁকে আর দেখা যায়নি। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা সব সময়ই ছিল। সেই নাসরিন এবার বইমেলায় এসে চমকে উঠেছেন। মতি মিয়া চরিত্রের ফারুক আহমেদের সঙ্গে পাশাপাশি বসেছিলেন কিংবদন্তি প্রকাশনীর স্টলে। সেখানে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তরুণ, যুবক, প্রবীণ—সব শ্রেণির দর্শক তাঁদের ঘিরে ধরেন। সবার প্রশ্ন, ‘আপনি ফুলি না?’, ‘আপনার অভিনয়ের আমি ভক্ত’, ‘কীভাবে আপনারা এক হলেন?’ এরপর একসঙ্গে ছবি তোলার বায়না ছিল ভক্তদের।
নাসরিন নাহার বলেন, ‘হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম না, মেলায় আসা অনেক দর্শক চিনতে পারছেন। তাঁরা এসেই বলছেন, ‘আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে, আপনি হুমায়ূন আহমেদের নাটকের ফুলি?’ দুই দিন বই মেলায় গিয়েছি, দুই দিনই দর্শক একই কথা বলেছেন। প্রতিবারই তো বইমেলায় যাই কিন্তু সচরাচর এটা হয় না। একা একাই সময় কাটিয়ে দিই। নিজের মতো করে ঘুরি। কিন্তু এবার সেই নাটক প্রচারের দিনগুলোর কথা মনে হলো। তখন দর্শকেরা ঘিরে ধরতেন। অটোগ্রাফ নিতেন। সেখানে এখন সবাই ছবি তোলার বায়না ধরেন। বেশ মজা পেয়েছি।’ বইমেলায় ভক্তদের আগ্রহ দেখে খুব বেশি সময় আর থাকতে পারেননি তাঁরা। নাসরিন জানান, অভিনেতা ফারুক আহমেদের সঙ্গে থাকার কারণে দর্শকেরা আরও বেশি তাঁদের চিনতে পেরেছিলেন। এরপরই ভক্তরা নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করেন।
অনেকেই ধারণা করেছিলেন তাঁরা হয়তো শুধুই সহকর্মী বা ভালো বন্ধু। আবার কেউ কেউ জানতেন তাঁরা বিয়ে করেছেন। কিন্তু এই দুই অভিনয়শিল্পীর বিয়ে নিয়ে বইমেলায় আসা ভক্তদের অনেক আগ্রহ ছিল। অভিনেতা ফারুক আহমেদ বলেন, ‘অনেকের আগ্রহ, আমরা কবে বিয়ে করেছি। নাটক থেকেই আমাদের প্রেম কি না। কেউ কেউ বলছিলেন নাটক থেকেই আপনাদের প্রেম, বিয়ে করেছেন কবে—এমন নানা প্রশ্ন। তাঁদের বললাম, আমি যখন নাটকে অভিনয় করি, তখনই আমরা বিবাহিত ছিলাম। এটা শুনেও তাঁদের আগ্রহ ছিল। আমরা বিয়ে করেছি, তারপর প্রেমের অভিনয় দারুণ করেছি। আবার কেউ বলছিলেন, ভাবি বাস্তবে কি নাটকের চরিত্রের মতো রাগী কি না। সব মিলিয়ে ভক্তদের সঙ্গে বইমেলার সময়টা বেশ ভালো কেটেছে।’
ফারুক আহমেদ নিয়মিত অভিনয় করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। প্রায়ই তাঁকে ভক্তদের সঙ্গে দেখা যায়। কিন্তু অভিনয় থেকে দূরে থাকা নাসরিনকে দেখে ভক্তদের গল্প যেন আর থামে না। এই ফুলি চরিত্রের অভিনেত্রী বলেন, ‘ভক্তদের যে কত কথা, কেউ বলছিলেন, আপনি আগে অনেক সুন্দর ছিলেন। এখন মোটা হয়ে গিয়েছেন কেন, কেন অভিনয় করেন না, করলে ভালো করতাম। এগুলো বেশ ভালো লাগছিল। আমরা একসঙ্গে একমাত্র নাটকে অভিনয় করেছি। সেই চরিত্রটিকে দর্শক মনে রেখেছেন, এটা অন্য রকম প্রাপ্তি।’
দুই বছর ধরে ফারুক আহমেদের সঙ্গে নাসরিনের অভিনীত ‘আজ রবিবার’ নাটকের দৃশ্যগুলো নানাভাবে ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে। সেসব ভিডিওর ভিউ কয়েক কোটি। নাসরিন বলেন, ‘আমি এখনো ফেসবুক, ইউটিউবে নিয়মিত আমাদের দৃশ্যের ভিডিও পাই। সেখানে ভক্তদের প্রশংসা আমাকে মুগ্ধ করে। প্রায়ই আমি একটা বিষয় লক্ষ করি, আমাদের নাটকের দৃশ্যের ভিডিওগুলোর দেখে দর্শক মন্তব্য করে লেখেন, আপনাদের একসঙ্গে দেখলে ভালো লাগে। এবার বইমেলায় গিয়েও অনেক দর্শকদের কাছে শুনতে হয়েছে একই কথা বলেছেন, আপনাদের দেখলে ভালো লাগে। আমাদের ভালো বোঝাপড়াটা দর্শক কীভাবে বোঝেন জানি না। এটা আমার কাছে জীবনের একটি প্রাপ্তি বলে মনে হয়। কারণ, আমরা অনেক ভালো আছি। আমরা সুখে আছি।’
অভিনয় কেন করলেন না—এমন প্রশ্নে নাসরিন বলেন, ‘আমি সাধারণভাবে জীবন যাপন করতে ভালোবাসি। “আজ রবিবার” ধারাবাহিক নাটকটি জনপ্রিয় হওয়ার পরে আমাদের সবাইকে ভক্তরা চিনতে শুরু করেন। এটা আমার কাছে কেমন যেন লাগত। বাইরে বের হলেই ঘিরে ধরছে, এটা আমি উপভোগ করতাম না। আর তখন আমাদের মেয়ে ছিল। দুজন একসঙ্গে অভিনয় করলে মেয়েকে সময় দেওয়া হবে না। সেটা ভেবে আমি ফারুককে বললাম, তুমিই অভিনয় করো। আমি সংসারটা দেখি। কিন্তু ফারুক আমাকে বলত, অভিনয় করতে। আমি তখন থিয়েটারে অভিনয় করতাম। এভাবেই টেলিভিশন নাটক থেকে দূরে সরে যাই। কিন্তু কখনোই ভাবি নাই, আবার এভাবে দর্শক চিনতে পারবে।’
ফারুক আহমেদ চান, নাসরিন অভিনয়ে ফিরুক। তিনি বলেন, ‘সে প্রতিভাবান একজন অভিনেত্রী। আমি নিজেও তার অভিনয় পছন্দ করি। তাকে সব সময়ই বলি অভিনয় করতে। অনেক পরিচিত পরিচালকেরাও তাকে অভিনয় করতে বলেন। তার অভিনয় করে যাওয়ার সব রকম স্বাধীনতা রয়েছে। আগেও বলেছি ফিরতে, এখনো বলব ফিরতে।’ সংসার কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৯৯৩ সালে আমরা বিয়ে করি। আমাদের প্রেমটা ছিল ওয়ান সাইড লাভ। ঢাকা থিয়েটারে “সংলাপ” নাটকের মহড়ার সময় নাসরিনকে প্রথম দেখায় আমার ভালো লাগে, নাটকের মতো প্রেমে পড়ে যাই। পরে আমাদের বিয়েতে সবাই রাজি থাকলেও নাসরিন রাজি ছিল না। একই থিয়েটারের ছেলেকে বিয়ে করলে অন্যরা কী বলবে, সেটা ভেবে রাজি ছিলেন না। থিয়েটারের অনেকেই বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করায়। সেই থেকে আমাদের বোঝাপড়া ভালো। সবার ভালোবাসায় আমরা শেষ দিন পর্যন্ত একসঙ্গে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিতে চাই।’
এবার বইমেলায় এই দম্পতিকে একসঙ্গে দেখা যাওয়ার বেশ কারণ রয়েছে। ফারুক আহমেদের এবারই প্রথম বই লিখেছেন। তাঁর লেখা বইটির নাম ‘স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ’। নব্বই দশক থেকেই লেখক ও পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচয় অভিনেতা ফারুক আহমেদের। ব্যক্তিগত চেনাজানা আগে থাকলেও এই পরিচয় ছিল হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয়ের জন্য। অভিনয় দিয়েই হুমায়ূন আহমেদের মন জয় করে নেন এই অভিনেতা। তার পর থেকে দুই যুগের বেশি সময় প্রিয় মানুষের সঙ্গে কাজ, কখনো আড্ডায় জমে ছিল অনেক স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়েই বইটি। এ ছাড়া ফারুক আহমেদের লেখা ‘আমার ভাঙা চশমা’ নামেও আরেকটি বই মেলায় পাওয়া যাবে। আজও এই দম্পতি থাকবেন বইমেলায়।