৫৫ বছরের সংসার, কোন মন্ত্রে এতটা পথ পাড়ি দিলেন তাঁরা

আবুল হায়াত ও মাহফুজা খাতুন শিরিনছবি: ফেসবুক

বিনোদন অঙ্গনে হরহামেশা সংসার ভাঙার খবর শোনা যায়। এর মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে। তেমনই ব্যতিক্রম আবুল হায়াত, আজ তাঁর সংসারজীবনের ৫৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। মেজ দুলাভাই মনিরুজ্জামানের ছোট বোন মাহফুজা খাতুন শিরিনের সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন দাম্পত্যজীবনের ৫৫টি বছর। এই দীর্ঘ সংসার জীবনযাপনের একটাই রহস্য—বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা, সুখ–দুঃখ সবকিছুকে হাসিমুখে ভাগ করে নেওয়া।

আবুল হায়াতের লেখা আত্মজীবনীমূলক বই ‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ থেকে জানা যায়, পরিবারের সঙ্গে আবুল হায়াত থাকতেন চট্টগ্রামে। আর মাহফুজা শিরিন ঢাকার অদূরে বেরাইদে। বড় ভাইয়ের বিয়েতে পরিবারের সঙ্গে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। দুজনের প্রথম দেখা সেখানেই। তখন মাহফুজা শিরিনের বয়স চার বছর আর আবুল হায়াত ১০ বছরের। আত্মীয়তার সূত্রে দুজনের বিভিন্ন সময় দেখাসাক্ষাৎ হতো। তবে প্রেম হয় যখন তখন সময়টা ১৯৬৬ সাল, আবুল হায়াত তখন তৃতীয় বর্ষে পড়েন আর মাহফুজা শিরিন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ সময়টায় চিঠি লেখালেখি শুরু হয়। অনেক বাধা পেরিয়ে চিঠি বেচারা আসত–যেত দুজনের কাছে। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেজ দুলাভাই আবুল হায়াতকে সিনেমা দেখতে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যান। সেখানে বিয়ে নিয়ে প্রথম আলাপ। এরপর পারিবারিকভাবে কথাবার্তা এগোয়। দুই পক্ষের মুরব্বিরা মিলে ১৯৭০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের আক্‌দ করান। এরপর কেটে গেছে ৫৫ বছর। অনেক চড়াই–উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে দুজনের জীবন পার হয়েছে। এত কিছুর মধ্যে দুজন দুজনকে আঁকড়ে ছিলেন।

বিয়ের আসরে আবুল হায়াত ও মাহফুজা খাতুন শিরিন
ছবি: অভিনেতার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

আবুল হায়াতের মতে, ‘যাত্রাপথে কতশত আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, বাধা-বিপত্তি—সবকিছু আমরা বিশ্বাস, আস্থা আর ভালোবাসায় হাসিমুখে ভাগ করে নিয়েছি। সত্যি, জীবন কত চ্যালেঞ্জিং এবং মধুময়!’ মাহফুজা খাতুন শিরিনকে অভিনেতা আবুল হায়াত বিয়ে করেন ৫৫ বছর আগের এই দিনে। সেই দাম্পত্যজীবনের আজ ৫৫ বছর পার হলো। সুখে–দুঃখে একজন মানুষের সঙ্গে ৫৫ বছর পার করে দেওয়াটা আজকালকার হুটহাট সংসার ভাঙার এই সমাজে দারুণ এক দৃষ্টান্ত, উৎসবের উপলক্ষও বটে।

সুখ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে আবুল হায়াত বলেন, ‘সুখ হচ্ছে মানুষের চাওয়া। আকাঙ্ক্ষা। এটার একটা সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। চাওয়া কম থাকলে একটা মানুষের প্রাপ্তিটা বেশি হয়। আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি—চাইবা কম, তাহলে দেখবে সব সময় পাবে বেশি। আর বেশি চাইলে দেখবে নিরাশ হতে হচ্ছে। যা তোমার জীবনে একটা নেতিবাচক দিক চলে আসবে। সারা জীবন আমি সেটাই অনুসরণ করেছি। আমার চাওয়াটা সব সময় খুবই অল্প ছিল, কিন্তু সারা জীবন সবচেয়ে বেশিই পেয়েছি।’
বিনোদন জগতের বিচ্ছেদের খবর যতটা চর্চিত হয়, মিলনের খবর ততটা নয়। তাই সাধারণ দর্শকদের মতে, তারকাদের সংসার গড়া হয় ভাঙার জন্য। আসলেই তা–ই? দিন শেষে একজন তারকাও অন্যদের মতো সাধারণ মানুষ। এমন অসংখ্য তারকা দম্পতি আছেন, যাঁরা দশকের পর দশক একই ছাদের নিচে বাস করছেন। নতুন প্রজন্মের জন্য তাই আবুল হায়াত বলেন, ‘আমি সবাইকে বলতে চাই বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা নিয়েই এগিয়ে যেতে। চাওয়ার সীমাবদ্ধতাও যেন থাকে। কোনো কিছুতে ক্রেজি হলে চলবে না। এমন মানসিকতা পোষণ করব না যে আমার এটা পেতেই হবে। এটা করতে হবে। অমুকের মতো হতে হবে। অমুকের মতো করতে হবে। নিজের মতো করে ভালোবেসে কাজ করে যেতে হবে। স্বামী কিংবা স্ত্রীর কেউ কাউকে যেন না বলে, কেন আমার মতো হতে পারছ না, এসব অস্থির মানসিকতা দুজনকে পরিহার করতে হবে। তা না হলে কোনো সম্পর্কই টিকবে না। এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি অস্থিরতায়ও ভোগে। কোনো ধরনের অ্যাফোর্ট দেওয়া ছাড়া তাঁরা যেকোনো কিছু পেতে চায়—এটাও সবচেয়ে বড় সমস্যা।

আরও পড়ুন
আবুল হায়াত ও মাহফুজা খাতুন শিরিন
ছবি: সংগৃহীত

অনেক সময় সুখী দম্পতিরা বলে থাকেন ভুল মানুষকে বিয়ে করেছেন। আপনার কি কখনো তেমন কিছু মনে হয়েছে—এমন প্রশ্নে আবুল হায়াত বলেন, ‘আমার কখনো মনে হয়নি ভুল মানুষকে বিয়ে করেছি। আমি সব সময় মনে করি, দাম্পত্যজীবনে দুজন মানুষ দুটি অপরিচিত জায়গা থেকে একটা জায়গায় একত্র হয়েছি। ছোটবেলা থেকে একটি মেয়ে কী পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, তাঁর মানসিকতা কেমন—একজন পুরুষকে শুরুতে এটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বিয়ের পর একটা মেয়ে একেবারে নতুন একটা পরিবেশে আসে। একদিনে সে নিজেকে বদলে ফেলবে, এমনটা হতে পারে না। আমি মনে করি, স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই একটা আলাদা সংস্কৃতি তৈরি করবে। স্বামী–স্ত্রী দুজনে মিলে যে সংস্কৃতি তৈরি করে, সেটাই দাম্পত্যজীবন টিকে থাকার সেরা উপায়। আমরা সেভাবেই নিজেদের গড়ে নিয়েছি। আমার সন্তানদের বড় করে তোলা, মানুষ হিসেবে তৈরি করার পুরো কাজটি আমার স্ত্রী একাই করেছে। আমি চাকরি করেছি, সিনেমায় অভিনয় করেছি, টেলিভিশন নাটক করেছি, মঞ্চের কাজ করেছি—পরিবারকে সে একাই সামলেছে। ঘরের সব বিষয় সুন্দরভাবে সামলেছে, এটা অনেক বিরাট ব্যাপার।’

আরও পড়ুন
স্ত্রী মাহফুজা খাতুন শিরিনের সঙ্গে আবুল হায়াত

আবুল হায়াত এ–ও বলেন, ‘আজকের আমার আমিকে যদি ১০০ ভাগে ভাগ করি, তার ৭৫ শতাংশ তাঁর (স্ত্রী মাহফুজা খাতুন শিরিন) অবদানে। নাটকের প্রতি আমার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, ভালো লাগা, ভালোবাসা—এটার পেছনের অবদান, সমর্থনটা আমার স্ত্রীর ছিল সবচেয়ে বেশি। আমি দেশের বাইরে ছিলাম। বললাম চলে যাব দেশে—এটা বলার পর সে আমাকে বলেছে, তোমার যদি ভালো না লাগে তুমি চলে আসো। নাটক করতে আসলাম। সরকারি চাকরিতে থেকে নাটক করতে অসুবিধা হয়, বলল ছেড়ে দাও। এই সাপোর্টগুলো আমরা সব সময় জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। আর সত্যিকারের জীবনসঙ্গীরাই এমনটা করে থাকে।’

আবুল হায়াত ও মাহফুজা শিরিন দম্পতির দুই সন্তান—বিপাশা হায়াত ও নাতাশা হায়াত। রাতেই তাঁরা মা-বাবার দাম্পত্যজীবনের ৫৫ বছর পূর্তির জন্য শুভেচ্ছা জানান। বিপাশা ও তৌকীর দেশে না থাকায় নাতাশা–শাহেদ এবং তাঁদের সন্তানদের নিয়ে কেক কেটেছেন আবুল হায়াত ও মাহফুজা শিরিন। এ ছাড়া ফেসবুকে বিনোদন অঙ্গনের অনেকের পাশাপাশি তাঁর ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা শুভকামনা জানিয়েছেন। জীবনের সুন্দর দিনে তিনি তাঁর ও স্ত্রী-সন্তানদের জন্য দোয়া চেয়েছেন সবার কাছে। কদিন আগে নিজের কর্মময় জীবন নিয়ে ‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছেন আবুল হায়াত। সেখানে তাঁর ক্যানসার আক্রান্তের কথা বলেন বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পী। জীবনের এই কঠিন সময়ে মানুষটার পাশে ছায়ার মতো থেকেছেন স্ত্রী মাহফুজা শিরিন, তা–ও বললেন। স্ত্রী প্রসঙ্গে এদিন তিনি বলেছেন, ‘সারাটা জীবন আমার সঙ্গে; আমার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আনন্দ—সবকিছুতে সে। আজকে আমি এই যে তিনটা বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, শুধু তাঁর কারণে। সে আমার সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা, আমাকে শিখিয়েছে, আই এম আ ফাইটার।’

আরও পড়ুন

১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হায়াত। ১৯৪৭ সালে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন চট্টগ্রামে। মাত্র ১০ বছর বয়সে মঞ্চে ওঠেন অভিনয়ের জন্য। যে অভিনয়ের সঙ্গে এখনো নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন এই অভিনেতা। এরপর ১৯৬৯ সাল থেকে টিভি নাটকে অভিনয় করছেন তিনি।
দীর্ঘ অভিনয়জীবনে নাটকের পাশাপাশি ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘জয়যাত্রা’, ‘গহীনে শব্দ’সহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ২০০৮ সালে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন।